মুক্তিযুদ্ধের শহীদ : মিথ্যা হিসাব যেন ওদের বিশ্বাসের অঙ্গ

সিরাজুর রহমান

লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত আমার একটি চিঠিকে কেন্দ্র করে সৈয়দ বদরুল আহসান ২ জুন তারিখের ডেইলি স্টার পত্রিকায় আমার কিছু অন্যায্য সমালোচনা করেছেন। আমার কোনো সন্দেহ নেই প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানের অভাব, অন্য কারো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভুল বিবরণের প্রভাব কিংবা রাজনৈতিক গোঁয়ার্তুমি থেকে তিনি এ প্রবìধটি লিখেছেন। তার বক্তব্যগুলোর জবাব দেয়ার আগে পটভূমি বর্ণনা করা প্রয়োজন।

ইয়ান জ্যাক একজন প্রবীণ এবং সম্মানিত সাংবাদিক। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনিও কিছু সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এখনো মাঝে মাঝে তিনি দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে, বিশেষ করে কলকাতায় সফর করতে যান। বর্তমানে তিনি প্রতি শনিবারের গার্ডিয়ান পত্রিকায় খুবই জনপ্রিয় একটি কলাম লেখেন। বাংলায় অনুবাদ করলে গত ২১ মে তারিখে তার কলামের শিরোনাম হবে : ‘গুরুত্ব গণহত্যার সংখ্যাতত্ত্বের মধ্যে নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে গণহত্যার ব্যাপারে আমাদের মনোযোগী হওয়া।’

এ প্রবìেধ ইয়ান জ্যাক অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্রতী শর্মিলা বোসের আসন্ন প্রকাশিতব্য একখানি বই নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলা অনুবাদে সে বইয়ের নাম হচ্ছে ‘মুর্দার হিসাব : বাংলাদেশ যুদ্ধের স্মৃতি’। উল্লেখ্য, শর্মিলা বোস নেতাজী সুভাস বোসের বড় ভাই শরত বোসের বংশধর। ইয়ান জ্যাক তার বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : যে যুদ্ধে বাংলাদেশের জন্ম হয় বিগত ৪০ বছর ধরে সে যুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্ববাসীর ধারণাজুড়ে আছে কথা ও সংখ্যার সমন্বয় নিয়ে চরম বিতর্ক। ইয়ান জ্যাক লিখেছেন যে, ২৫ মার্চ রাতে সামরিক হামলার আগে এবং স্বাধীনতার পর বাঙালিরাও অবাঙালিদের ওপর নৃশংসতা চালিয়েছে, বিশেষ করে খুলনার পাটকলগুলোতে যা ঘটেছে সেটাকেও একধরনের গণহত্যা বলা যায়।

শর্মিলা বোস তার গবেষণার ফলাফল সম্পর্কে বলেছেন, সঙ্গত অনুমান এই যে, কয়েক হাজার নর-নারী ও শিশু খুলনায় (বাঙালিদের দ্বারা) নিহত হয়েছে। মিস বোসের গবেষণা অনুযায়ী উভয় পক্ষে মোট ৫০ হাজার থেকে এক লাখ মানুষ ১৯৭১ সালের যুদ্ধে মারা গেছে। আর ইয়ান জ্যাক মন্তব্য করেছেন : বাংলাদেশ যুদ্ধ সম্পর্কে একটা উল্লেখযোগ্য সত্য এই যে, খুব কমসংখ্যক শিক্ষাব্রতী ও ঐতিহাসিক এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে বলে সব পক্ষ থেকেই অভিযোগ উঠেছে এবং উঠছে। এমনকি সৈয়দ বদরুল আহসানও অত্যন্ত অনুদারভাবে আমার বিরুদ্ধে ইতিহাসকে ‘মোচড় দেয়ার’ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু এ কথা সত্যি যে, এ ইতিহাস সম্পর্কে অনেকগুলো অসত্য নিয়ে আমরা গত ৪০ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এর মধ্যে একটি প্রজন্ম বিগত হয়েছে, আরেকটি শিগগিরই বিগত হবে। কথা হচ্ছে ভবিষ্যতকেও কি আমরা আমাদের জাতীয় ইতিহাসকে মিথ্যার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখব? ঠিক এই বিবেচনা থেকেই ইয়ান জ্যাকের কলাম সম্পর্কে আমি গার্ডিয়ান পত্রিকাকে একখানি চিঠি লিখি এবং সে চিঠি প্রকাশিত হয়েছে গত ২৪ মে। সে চিঠির হুবহু বক্তব্য বর্তমান প্রবìেধর শেষে সংযুক্ত হচ্ছে। কিন্তু একটি সত্যি ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হলে আমার বক্তব্য ও তার অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নেপালের রাজা মহেন্দ্র (বীরেন্দ্রের পিতা) ব্রিটেনে রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। বিবিসি থেকে তখন নেপালি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো না। কিন্তু রাজার সফরের বিবরণ বিবিসি নেপালের মানুষকে শোনাতে চেয়েছিল। রাজা মহেন্দ্রের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য খোঁজখবর করে একজন নেপালি ছাত্রকে আনা হলো। ধর্মভীরু হিন্দু নেপালিরা তখন তাদের রাজাকে ‘জীবিত ঈশ্বর’ বলে বিবেচনা করত। এমনকি কোনো প্রজার রাজার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা গুরুতর অপরাধ বলে বিবেচিত হতো। বিবিসির সংগৃহীত ছাত্রটি রাজার হোটেলে তার সামনে উপুড় হয়ে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়ল নিচের দিকে তাকিয়ে, আর মাইক্রোফোনটা রাজার দিকে উঁচিয়ে ধরল।

আত্মসমর্পণের সাংবাদিকতা
এ ঘটনার কথা আমি প্রায়ই ভাবি। লোকটি যদি ছাত্র না হয়ে কোনো নেপালি সাংবাদিক হতো তাহলে কি নিজ দেশের সমস্যাদির যথাযথ বিশ্লষণ ও সদুত্তর রাজার কাছ থেকে আদায় করতে পারত? সমাধানের কোনো গঠনমূলক প্রস্তাবও রাজাকে দিতে পারত? বাংলাদেশে একশ্রেণীর রাজনীতিক এবং কিছু সংখ্যক সাংবাদিক এখনো স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে অন্তত প্রকাশ্যে যে মনোভাব দেখান সেটা রাজা মহেন্দ্রের প্রতি তার হিন্দু প্রজা উপরিউক্ত ছাত্রটির মনোভাবের সাথে তুলনীয়। তবে বিশেষ করে আমি সাংবাদিকদের প্রসঙ্গেই আলোচনা করব।

শেখ মুজিবুর রহমান শুধু জাতির পিতাই ছিলেন না। তিনি আরো ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারপ্রধান। দলীয় রাজনীতিতে সব সময়ই বিতর্ক থাকতে বাধ্য। তা ছাড়া একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত সমস্যাসঙ্কুল দেশ শাসনের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ভুলত্রুটিরও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হতে পারে। বাংলাদেশের বেলায় ঠিক তা-ই হয়েছে। একশ্রেণীর কিছু লোক প্রধানমন্ত্রীকে কবিতা শুনিয়েছে, ‘বঙ্গবìধু বঙ্গবìধু’ বলে তার স্তবস্তুতি করেছে, তাকে ফুলের মালা দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছে। সে সুযোগে তারা দুর্নীতি করেছে, দেশের সম্পদ লুটপাট করেছে। ১৯৭২-‘৭৩-এর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট আর চুয়াত্তরের মন্বন্তরে ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যুর এ ছিল কারণ। অন্য কিছু লোকের পরামর্শ ও প্ররোচনায় রক্ষীবাহিনী গঠিত হয়েছিল। সে বাহিনী আওয়ামী লীগের ৪০ হাজার বিরোধীকে (মূলত জাসদ কর্মী) হত্যা করেছে। কিছু লোকের কুপরামর্শে শেখ মুজিবুর রহমান বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের আফিন্সকার কোনো কোনো স্বৈরশাসকের মতো একদলীয় পদ্ধতি কায়েম করে আজীবন রাষ্ট্রপতি হতে যাচ্ছিলেন।

বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা দেশের বাস্তব পরিস্খিতি শেখ মুজিবকে জানতে দেননি, প্রশাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরেননি তারা, সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো গঠনমূলক প্রস্তাবও তাকে দেননি। নইলে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে লিখিত হতে পারত। দেশ যখন সর্বনাশের অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছিল সাংবাদিকেরা তখনো ‘বঙ্গবìধু’ ‘বঙ্গবìধু’ বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দনা করছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলে এই ব্যক্তিপূজা সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে।

আমি নিজের চোখে দেখেছি এই ‘বঙ্গবìধু বন্দনায়‘ যারা বাড়াবাড়ি করেছেন তারা হয় কোনো ত্রুটি ঢাকতে চেয়েছেন, নয়তো কোনো অনুগ্রহ প্রত্যাশী ছিলেন। একাত্তরে লন্ডনে আমাদের ঘনিষ্ঠ দু’জন আমাদের স্বাধীনতার আন্দোলনে সামান্যতম অংশ নেননি, এক পাউন্ড চাঁদাও দেননি, এমনকি পাকিস্তানিরা দেখে ফেলতে পারে ভয়ে তারা আন্দোলনকারী বìধুবাìধবের ধারেকাছেও আসতেন না। কিন্তু দেশে ফিরে তাদের একজন শেখ মুজিবের সরকারের আমলে ‘বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক’ সেজে অধ্যাপনার চাকরিতে ডবল প্রমোশন সংগ্রহ করেছিলেন, অন্যজন শেখ হাসিনার হাত থেকে একুশে পদক আর স্বাধীনতা পুরস্কার নিয়েছেন।

বেঈমানি আল্লাহর প্রতি না বঙ্গবìধুর প্রতি?
মাত্র বিগত কয়েক দিনে সেক্টর কমান্ডার ফোরামের জেনারেল সফিউল্লাহ বলেছেন, সংবিধানে বিস্মিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা হলে বঙ্গবìধুর সাথে বেঈমানি করা হবে। শেখ মুজিবের জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রধানমন্ত্রীর মনোরঞ্জনের জন্য মুজিবের প্রতি অতিভক্তি দেখাতে গিয়ে তিনি ১৫-১৬ কোটি ধর্মভীরু মুসলমানের ধর্মীয় অনুভূতিতে তীব্র আঘাত হেনেছেন। অথচ বাংলাদেশে এখনো এমন বহুলোক বেঁচে আছেন যারা জানেন যে, ১৯৭৫ সালের সে কালরাতে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সাহায্য চেয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে টেলিফোন করেছিলেন। কিন্তু জেনারেল সফিউল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে কোনোমতে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসেছিলেন।

পাকিস্তানি পররাষ্ট্র দফতরে কূটনৈতিক পদে নিযুক্ত বাংলাদেশীদের পক্ষত্যাগ (ডিফেক্ট) করে স্বাধীনতা আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমিও অনেক চেষ্টা করেছি। বহু ক্ষেত্রেই আমরা সফল হয়েছি, কিন্তু কোনো কোনো কূটনীতিক বিশ্বাস করতে পারেননি যে বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। শেষ মুহূর্তে যখন আমাদের স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে উঠল মাত্র তখনই তারা আমাদের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নিজেদের সংশয় ও বিলম্ব ঢেকে দ্রুত পদোন্নতি পেতে তাদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি চেষ্টা করেছেন। এমন ভাব তারা করেছেন যেন আসলে তারাই ছিলেন সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। সেটা সম্ভব হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ছিলেন না বলে। কে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আর কে নয়, সেটা তিনি জানতে পারেননি। আর বর্তমানে তো একটি দলের রাজনৈতিক স্বার্থে প্রায়ই লাখে লাখে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিলি করা হচ্ছে। শুনেছি একাত্তরে এসব মেকি মুক্তিযোদ্ধার কারো কারো জন্ম হয়েছিল কি না সে নিয়েও সন্দেহ আছে।

এই হচ্ছে পটভূমি। সে পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত সৈয়দ বদরুল আহসানের প্রবìধটি নিয়ে আলোচনা করব। শর্মিলা বোসের বই নিয়ে ইতোমধ্যেই মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার হয়েছে। সে গ্রন্থ এবং ইয়ান জ্যাকের জনপ্রিয় কলাম থেকে পরিষ্কার যে, বিদেশে এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না একাত্তরে আমাদের ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিন মিলিয়ন অর্থাৎ ৩০ লাখ লোক মারা গেছে। একাত্তরে যেসব ব্রিটিশ ও বিদেশী সাংবাদিক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের খবরাদি বিশ্বকে জানিয়েছেন ১৯৭২ সালে তাদের অনেকে আমাকে বলেছেন তিন মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করতে পারেন না। বাংলাদেশেও বহু লোক এখনো তিন মিলিয়ন নিহত হওয়ার কথা বিশ্বাস করেন না। অবশ্য ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি যে ব্যাপক হয়েছে সেটাও সত্য। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধি বলেও একটা কথা আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৪ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্য্যন্ত ১১ বছর ভিয়েতনাম যুদ্ধে সর্বশক্তি আর সর্বপ্রকারের মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে। কিন্তু প্রাপ্ত সব হিসাব অনুযায়ী সে যুদ্ধে উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম মিলিয়ে সামরিক ও বেসামরিক নিহতদের সংখ্যা তিন মিলিয়নের সামান্য বেশি।

সংখ্যাতাত্ত্বিক বিভ্রাট
গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠিতে আমি এই সংখ্যাতাত্ত্বিক বিভ্রাটের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি শনিবার অতি ভোরে আমি খবর পাই যে, শেখ মুজিব লন্ডনে নেমেছেন এবং ভারতীয় হাইকমিশনার আপাভাই পন্থ তাকে ক্ল্যারিজেস হোটেলে নিয়ে আসছেন। আমি সরাসরি ক্ল্যারিজেস হোটেলে চলে গেলাম। সোফার ওপর ক্লান্ত ও বিষন্ন মুজিব ভাই বসেছিলেন। আমাকে দেখে চিনতে পারলেন, আশ্বস্ত হয়েছিলাম তাতে। আমাকে হাতের ইশারায় পাশে বসতে বললেন। ওখানে তখন ছিলেন আর মাত্র দু’জন। হাইকমিশনার আপাভাই পন্থ হন্যে হয়ে টেলিফোন করছিলেন। আর ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশনের ‘এইড’ (সহকারী) শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি। উল্লেখ্য, এই ব্যানার্জি রাজকীয় বিমান বাহিনীর কমেট বিমানে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘এইড’ হয়ে ঢাকা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আরো উল্লেখ্য, ব্রিটেন তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং ব্রিটিশ সরকারের সাথে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করত ভারতীয় হাইকমিশন।
একপর্যায়ে হাইকমিশনার পন্থ টেলিফোন মুজিব ভাইয়ের হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘ইয়োর এক্সেলেন্সি’, ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে পেয়েছি, তিনি এখন লাখনৌতে আছেন। মুজিব ভাই ওখানেই টেলিফোন নিতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে সিলেটি বংশোদ্ভূত ব্যবসায়ী মিনহাজ উদ্দিন ও অন্য একজন ওখানে উপস্খিত হয়েছেন। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট লোকজনের সামনে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন সেটা আমার ভালো মনে হয়নি। আমি মুজিব ভাইয়ের হাত ধরে তাকে টেনে তুললাম এবং তাকে স্যুইটের বেডরুমে নিয়ে গেলাম। তাকে চেয়ারে বসিয়ে টেলিফোন রিসিভার তার হাতে দিয়ে আমি বেরিয়ে এসে দরজা বìধ করে দিলাম।

প্রায় ২০ মিনিট পর মুজিব ভাই বেরিয়ে এলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমারে এক্সেলেন্সি কইলো ক্যান?’ আমি বললাম, ‘আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট, আপনাকে এক্সেলেন্সি কইবো না তো কইবো কী?’ মুজিব ভাইয়ের সাথে আমি বরাবরই এ রকম হালকা সুরে কথা বলতাম। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি আবার কিসের প্রেসিডেন্ট হইলাম, আমরা না অটোনোমি পেলাম?’
আমি তাকে বললাম, ‘মুজিব ভাই, আপনি তো দেশে ছিলেন না, আপনার নামে আমরা গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে ফেলেছি, আমরা দেশ স্বাধীন করে ফেলেছি।’ তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, আমিও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। বেশ কয়েক মিনিট কেটে গেল। জাকারিয়া খান চৌধুরী এলেন। এলেন অধ্যাপিকা সুরাইয়া খানম, মুজিব ভাইয়ের পা ছুঁয়ে তাকে সালাম করলেন। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছিস? আমি অস্বস্তিতে উসখুস করছিলাম। মাত্র তখনই তিনি আলিঙ্গনমুক্ত করলেন আমাকে। এর পর তিনি গিয়ে সোফায় বসলেন, আমিও বসলাম তার পাশে। হোটেলের রুম সার্ভিস স্যান্ডউইচ আর কফি এনেছিল। তিনি খানিকটা কফি খেলেন। আমি তাকে দেশের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কথা বলছিলাম। তিনি জানতে চাইলেন কত লোক মারা গেছে যুদ্ধে। আমি বললাম যুদ্ধের সরাসরি খবর পাওয়া সম্ভব ছিল না কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরাদি থেকে আমরা অনুমান করেছি যে প্রায় তিন লাখ মানুষ মারা গেছে মুক্তিযুদ্ধে। পরে ডেভিড ফন্সস্টকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুজিব ভাই বলেছিলেন যে, পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধে তিন মিলিয়ন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছিল। এই হচ্ছে ঘটনা।

বোলতার চাকে ঢিল
গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখিত চিঠিতে আমি এই পটভূমি দিয়ে বলেছিলাম যে, শেখ মুজিবুর রহমান হয়তো বেমওকা লাখকে মিলিয়ন বলে ফেলেছিলেন, নয়তো ক্লান্ত অবস্খায় সে ভুলটা তার হয়েছিল। মনে হচ্ছে তিন মিলিয়ন মানুষ মারা যাওয়া সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে আমি একটা প্রভাবশালী মহলের বিশ্বাসে আঘাত করে ফেলেছি। ডেইলি স্টার পত্রিকায় সৈয়দ বদরুল আহসানের প্রবìেধর উল্লেখ আগেই করেছি। সে প্রবìধ প্রকাশিত হয়েছে ২ জুন। একই তারিখের গার্ডিয়ান পত্রিকা বাংলাদেশ হাইকমিশনের রাশেদ চৌধুরীর একখানি চিঠিও ছেপেছে। লক্ষ করা যাচ্ছে যেন ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি হিথরো বিমানবন্দরে আর ক্ল্যারিজেস হোটেলে যা যা ঘটেছিল তার প্রায় অভিন্ন ‘প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ’ লিখেছেন তারা। সেদিন ভোরে আমি হিথরো বিমানবন্দরে যাইনি তাই তারা সেখানে ছিলেন কি না বলতে পারব না। কিন্তু দিনের একটা বড় অংশ আমি ক্ল্যারিজেস হোটেলে ছিলাম এবং আমি আশ্বাস দিতে পারি যে তাদের কেউ সেদিন সে হোটেলে ছিলেন না।

সৈয়দ বদরুল আহসান ও রাশেদ চৌধুরী লিখেছেন যে, শেখ মুজিব সেদিন ভোরে আপাভাই পন্থের গাড়িতে ক্লারিজেস হোটেলে আসেননি, এসেছিলেন বেসরকারি বাংলাদেশ দূতাবাসের কূটনীতিক রেজাউল করিমের গাড়িতে। সৈয়দ বদরুল আহসানের ভাষায় তিনি ‘লাফ দিয়ে’ রেজাউল করিমের গাড়িতে ওঠেন। রাশেদ চৌধুরীর চিঠি থেকে মনে হতে পারে যে, আপাভাই পন্থ সেদিন ক্ল্যারিজেস হোটেলেই ছিলেন না। তাদের কেউ এমন আভাসও দেননি যে, আমি সেদিন ক্ল্যারিজেস হোটেলে ছিলাম এবং শেখ মুজিবের সাথে আমার বহু কথাবার্তা হয়েছে। তারা বলতে চেয়েছেন যে পূর্ব পাকিস্তানে ও স্বাধীন বাংলাদেশে যা যা হয়েছে সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হয়েই মুজিব পাকিস্তান থেকে লন্ডনে এসেছিলেন। প্রমাণ হিসেবে তারা লিখেছেন যে, ড. কামাল হোসেন সপরিবারে একই বিমানে এসেছিলেন।

অনেক প্রশ্ন ওঠে এখানে। শেখ মুজিব নিজেই বলেছেন, তার কবর খোঁড়ার দৃশ্য তিনি নিজেই দেখেছেন। তিনি আরো বলেছেন যে, দেশের খবর পাওয়ার কোনো উপায় তার ছিল না, কারাগারে তাকে পত্রিকা কিংবা রেডিও দেয়া হয়নি। ড. কামাল হোসেন মুজিবের সাথে কয়েদ ছিলেন না, শুনেছি তিনি ছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। পাকিস্তানের কঠোর সেন্সরশিপ আর পাকিস্তানি অপপ্রচারের ডামাডোলে মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী পরিস্খিতির কতটা সত্যি বিবরণ তিনি জানতে পেরেছিলেন সন্দেহ আছে। তা ছাড়া একই বিমানে মুজিবের দেহরক্ষী হয়ে এসেছিলেন পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর একজন কর্মকর্তা, শুনেছি তার নাম ছিল লে. কর্নেল রিয়াজুল ইসলাম। সুতরাং বিমানেও মুজিবকে পরিস্খিতি জ্ঞাত করানোর সুযোগ ড. কামাল হোসেন কতটা পেয়েছেন বলা কঠিন।

সেদিন ক্ল্যারিজেস হোটেলের সামনে বহু বাংলাদেশীর সমাগম হয়েছিল এবং সìধ্যায় তিনি হোটেলে বিরাট সংবাদ সম্মেলন দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন সৈয়দ বদরুল আহসান আর রাশেদ চৌধুরী। মনে হতে পারে তারা যেন ‘মাকে মামার বাড়ির গল্প শোনাচ্ছেন। এসব কথা আমি সেদিন বিবিসি রেডিওতে প্রচার করেছি, গত ৪০ বছরে বহুবার লিখেছি। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘প্রীতি নিন সকলে’ আর ২০১০ সালে প্রকাশিত ‘এক জীবন এক ইতিহাস’ বইতে সেদিনের ঘটনাবলির বিস্তারিত বিবরণ লিখেছি আমি। পড়ে দেখলে তারা উপকৃত হবেন। তা ছাড়া সেদিন মুজিবের সংবাদ সম্মেলনের ফিল্ম কিংবা ভিডিও পরীক্ষা করলে তারা অবশ্যই দেখতে পাবেন যে তার বিবৃতির পুরো সময় আমি মঞ্চের ওপর তার বাম দিকে তার চেয়ার ঘেঁসে হাঁটু গেড়ে বসে মাইক্রোফোন ধরে ছিলাম। বাংলাদেশের কাদা নিয়ে বিদেশে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চাইনি বলে রাশেদ চৌধুরীর বক্তব্যের জবাব গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাঠাইনি।

মুজিব মানুষ ছিলেন
সমস্যা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমান যে ফেরেশতা ছিলেন না, মানুষ ছিলেন, তার অìধ ভক্তরা সেটা মানতে রাজি নন। এবং সব ভাষাতেই একটা কথা আছে যে মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ১০ মাসের নির্জন কারাবাস, তারপর কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে রাত জেগে পাকিস্তান থেকে লন্ডন পর্যন্ত বিমানভ্রমণ এবং হঠাৎ করে আবেগাপ্লুূত সমর্থকদের সান্নিধ্য ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে মুখ ফসকেও ভুল কথা বেরিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। তাই বলে মুজিবকে যারা ভালোবাসতেন তারা ইতিহাসকে সংশোধন করে দিলে মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধাবোধই প্রমাণিত হবে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারির যে বিবরণ পড়ে সৈয়দ বদরুল আহসান আর রাশেদ চৌধুরী আমার সমালোচনা করেছেন তথ্য বিকৃতি আছে সে বিবরণে, গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত আমার চিঠিতে নয়। সে চিঠির হুবহু বিবরণ ছিল এ রকম :
Mujib's confusion on Bangladeshi deaths Ian Jack (21 May) mentions the controversy about death figures in Bangladesh's liberation war. On 8 January 1972 I was the first Bangladeshi to meet independence leader Sheikh Mujibur Rahman after his release from Pakistan. He was brought from Heathrow to Claridge's by the Indian High Commissioner Apa Bhai Panth, and I arrived there almost immediately. Mujib was puzzled to be addressed as "your excellency" by Mr Panth. He was surprised, almost shocked, when I explained to him that Bangladesh had been liberated and he was elected president in his absence. Apparently he arrived in London under the impression that East Pakistanis had been granted the full regional autonomy for which he had been campaigning. During the day I and others gave him the full picture of the war. I explained that no accurate figure of the casualties was available but our estimate, based on information from various sources, was that upto "three lakh" (300,000) died in the conflict. To my surprise and horror he told David Frost later that "three millions of my people" were killed by the Pakistanis. Whether he mistranslated "lakh" as "million" or his confused state of mind was responsible I don't know, but many Bangladeshis still believe a figure of three million is unrealistic and incredible.

Serajur Rahman
Retired deputy head, BBC Bengali Service
(লন্ডন, ০৮.০৬.১১)
http://www.dailynayadiganta.com/fullnews.asp?News_ID=282461&sec=6