পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর

প্রথম আলো রিপোর্ট
তারিখ: ২৮-০১-২০১০

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোররাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করেছিল ঘাতকেরা। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর হলো গতকাল ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরও ছয় খুনি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলাতক। অন্য একজন মারা গেছেন।

গতকাল বুধবার রাত ১২টার পরপরই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ আসামির মধ্যে প্রথমে বজলুল হুদা ও মুহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। সাড়ে ১২টার দিকে সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান এবং রাত একটা পাঁচ মিনিটে এ কে এম মহিউদ্দিনের (ল্যান্সার) ফাঁসি কার্যকর হয়। এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট, সিভিল সার্জন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কারা প্রশাসনের পদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর পাঁচজনের লাশ বিশেষ পাহারায় অ্যাম্বুলেন্সে করে তাঁদের নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। সকালের মধ্যে লাশগুলো দাফনের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কসবা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি জানান, রাত আড়াইটায় এই প্রতিবেদন লেখার সময় গোপীনাথপুর গ্রামে পুলিশের পাহায়ায় কবর খোঁড়া হচ্ছিল।

ফাঁসির রায় কার্যকর করতে গতকাল বিকেলের পর থেকে কারাগারের আশপাশে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়। শত শত পুলিশ ও র্যাব সদস্য চারদিক থেকে কারাগার ঘিরে রাখেন। সন্ধ্যার পর রাজধানীর চানখাঁরপুল মোড় থেকে কারাগারের প্রবেশ মুখে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ সময় অনুমোদিত লোকজন ছাড়া কাউকে চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। রাতে নগরের অন্যান্য স্থানেও নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।

সকাল সাড়ে নয়টায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হওয়ার পর থেকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রস্তুতি শুরু হয়।

রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হওয়ার পর পাঁচ আসামির মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান বিকেলে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘুরে অতি দ্রুত ওই আবেদন বঙ্গভবনে পৌঁছায় এবং সঙ্গে সঙ্গে তা নাকচ হয়। রাতে তা ফারুক রহমানকে জানানো হয়। রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন নাকচ হওয়ার মাত্র ১৫ ঘণ্টা পরেই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। গতকাল রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন।

সরকারি দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, বৃহস্পতিবার প্রথম প্রহরে ফাঁসি কার্যকর করার সব ধরনের প্রস্তুতি আগে থেকেই নিয়ে রাখে কারা কর্তৃপক্ষ।

এর আগে দুপুরে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ৩১ জানুয়ারির মধ্যেই ফাঁসি কার্যকর হবে। নিরাপত্তার কারণে ফাঁসির স্থান ও সময় গোপন রাখা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই গোপন থাকেনি। বিকেলের পর থেকেই সংবাদকর্মীরা কারাগারের সামনে ভিড় করতে শুরু করেন। এর আগে সরকারের উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বৈঠক করে নিরাপত্তার প্রস্তুতি নেন।

কারাবন্দী পাঁচ আসামির সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের শেষবারের মতো দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়। সাক্ষাত্ শেষে বেরিয়ে আসা স্বজনদের চোখেমুখে উত্কণ্ঠা ছিল। তাঁরা উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, লাশ হস্তান্তর নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কারা কর্তৃপক্ষের কথা হয়েছে। ভেতরে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত অবস্থায় তাঁরা দেখেছেন। তাঁদের ফোন নম্বর রেখে দিয়েছেন কারা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

সূত্র জানায়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরে একটিমাত্র ফাঁসির মঞ্চ ছিল। পাঁচজনের ফাঁসির জন্য আরও দুটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। ফাঁসির জন্য রশি ও অন্যান্য সরঞ্জামও প্রস্তুত করা হয়। সর্বশেষ গতকাল রাত আটটার দিকেও বাইরে থেকে মঞ্চের সরঞ্জাম ভ্যানে করে ভেতরে নেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পুরোনো মঞ্চেই ফাঁসি কার্যকর হয়। কারণ, নতুন মঞ্চ দুটি ফাঁসি কার্যকরের মতো পুরো উপযোগী হয়নি।

সূত্র জানায়, কাশিমপুর-১ কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী ৬০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত শাহজাহান ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা হত্যা মামলায় যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত কালু জল্লাদ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের সহযোগিতা করেন আরও তিন কয়েদি।

কাশিমপুর কারাগার থেকে রাত ১০টা ১০ মিনিটে সাদা রঙের দুটি পিকআপ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকে আসে। সামনের পিকআপে ছিলেন খুনি মুহিউদ্দিনের দুই ছেলে। পেছনের পিকআপে ছিলেন তিন জল্লাদ। জল্লাদ শাহজাহান ও তাঁর সহযোগী বাবুল ও মনিরের পরনে কয়েদির পোশাক ও ডান্ডাবেড়ি ছিল। তাঁরা কারাগারের প্রধান ফটক দিয়ে ঢোকার সময় ভেতরে সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হয়। এর পরই কারাগারের ভেতরে ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

কারাগারের আশপাশের ভবনগুলোর ছাদে পুলিশ সতর্ক অবস্থান নেয়। ভবনগুলোর জানালা বন্ধ করে দিয়ে বাসিন্দাদের ভেতরে থাকতে বলা হয়। সন্ধ্যা সাতটার পর কারাগারের দেয়ালঘেঁষা সব সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে র্যাব ও পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দারা অবস্থান নেয়।

রাত ১১টা ১০ মিনিটে আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকার জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকার, ঢাকার সিভিল সার্জন মুশফিকুর রহমান, সহকারী সিভিল সার্জন শামসুদ্দিন এবং রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্বরাষ্ট্রসচিব আবদুস সোবহান সিকদার কারাগারে ঢোকেন। এর পরপরই একটি পিকআপে করে পাঁচটি কফিন কারাগারের ভেতরে নেওয়া হয়, লাশের গোসল করানোর চৌকি পাঠানো হয় এর পরপরই।

গতকাল রাতে ফাঁসির মঞ্চের পাশে অনেকের সঙ্গে ছিলেন কারা তত্ত্বাবধায়ক তৌহিদুল ইসলাম। তাঁর হাতে ছিল একটি লাল রঙের রুমাল। তিনি হাত থেকে রুমাল ফেলার সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টেনে দেন। এতে পায়ের তলা থেকে কাঠ সরে গিয়ে ফাঁসি কার্যকর হয়। পরে চিকিত্সক লাশ পরীক্ষা করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। লাশের প্রতিবেদন তৈরি করেন ম্যাজিস্ট্রেট। ফাঁসিতে মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিবেদন তৈরি করেন। এরপর গোসল করিয়ে একে একে লাশগুলো কফিনে ভরা শুরু হয়।

কারাগারের চারপাশে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা থাকলেও ফাঁসি কার্যকর করার কথা শুনে শত শত উত্সুক মানুষ সেখানে ভিড় করে। ভিড় সামাল দিতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। মানুষের ভিড় উপচে পড়ে পুরো নাজিমউদ্দিন সড়কে। দুই শিশুকে দেখা যায় ফাঁসির দাবির ব্যানার হাতে শীতের রাতে কারা ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁসি কার্যকর করার খবর শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা মিছিল বের করে। কারাগারের আশপাশেও মিছিল দেখা যায়।

সূত্র: প্রথম আলো
বৃহস্পতিবার, ২৮ জানুয়ারি ২০১০