সৈয়দ আলীর দিনরাত্রি

Submitted by WatchDog on Saturday, May 23, 2009

সৈয়দ আলী গ্রামে-গঞ্জে ফেরী করে বেড়ায়, দিন শেষে যা আয় হয় তা দিয়ে ৭ জনের সংসার টানতে হয়। মাসের অর্ধেক সময় দু’বেলা খাবার জোটাতে কষ্ট হয়, নুন থাকলে পান্তা নেই, পান্তা থাকলে নুন নেই। এ ভাবেই চলে সৈয়দ আলীর জীবন। ঘরে ৪টা সোমত্ত মেয়ে, ২ জোয়ান ছেলে অল্প বয়সে বিয়ে করে বাড়ি ছাড়া, ছোট ছেলের বয়স ২ বছর। অভিযোগ করার মত কিছু ঘটেনা জীবনে, তা ছাড়া কার কাছেই বা করবে অভিযোগ, এটাই যে সৈয়দ আলীদের জীবন।

ভোটের সময় সৈয়দ আলীর কদর বেড়ে যায় হু হু করে, তার ছিন্নমূল ভিটা হাতী ঘোড়ার পদভারে কাপতে শুরু করে বৈশাখী ঝড়ের মত। সৈয়দ আলীর ৩২ দাতের এমন নির্জলা হাসি দেখে তার সূখে-দূখের সাথী ছমিরন বিবিও ভয় পেয়ে যায়। ‘ভাবিস নারে ছমিরন, এইবার আর অভাব থাকবিনিনে, চেয়ারমেন কথা দিছে, এইবারের ইলিকশনে ইলশা হাজীকে এমপি বানানিগেলে টেকা দিব, অনেক টেকা। গোলাক্তার আর নছিফার বিবাহ দিব, আইনুন নাহারকে স্কুলে ভর্তি করাইব, আর তোর জন্যে গঞ্জের হাট হতি একখান ১০হাতি শাড়ি আনি দিব’। আবারও ৩২ দাত বের করে সোনালী স্বপ্নের হাসি হাসতে থাকে সৈয়দ আলী।

ইলেকশনে ইলশা হাজি ধানের শীষ মার্কা নিয়ে জিতে যায় বিপুল ভোটে। গ্রামে গঞ্জে তিন দিন ধরে আমোদ ফুর্তি চলতে থাকে। ইলশা হাজি আগামী শীতে বসন্তপুর গ্রামে পালা গানের আয়োজন করতে যাচ্ছে খবরটা শুনে সৈয়দ আলীর শরীরে বিদুৎ খেলে যায়, রক্তের ভেতর পুরানো সাপটা নতুন করে হিস হিস করতে শুরু করে। চারদিকে সূখের প্লাবন দেখতে পায় সৈয়দ আলী।

পৌষের কোন এক পরন্ত বিকেলে গঞ্জের দিকে রওয়ানা দেয় সৈয়দ আলী, আজ তাকে দেখা করতেই হবে ইলশা হাজির সাথে। ছোট মেয়েটাকে টেনে হিছড়ে ছিনিয়ে নিতে চাইছে ইলশা হাজির এক ছেলে, সাথে তার শহুরে ইয়ার দোস্ত। তাছাড়া ইলিকশনে পাশ করলে তার জন্যে কিছু একটা করার প্রতিশ্রুতির কথাটাও মনে করিয়ে দেয়ার সময় হয়েছে। এমন একটা ছোট শহরে এমন আলীশান বাড়ি দেখে ভড়কে যায় বসন্তপুরের সৈয়দ, দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়। বাড়ির আংগিনায় হরিন, গাছের ডালে হরেক রকম পাখীর মেলা, মূল ফটকে বাঘের হিংস্রতা নিয়ে দাড়িয়ে আছে দু’দুটো ভিনদেশী কুকুর। এমন শান শওকতের হাজি সাহেব কি করে সৈয়দ আলীর নোংরা আংগিনায় পা রেখেছিল তা ভাবতেই সন্মানের পাহাড়ে চড়িয়ে দিল ইলশা হাজিকে। হাজি সাহবের দিলটা কত বড় হতে পারে তা হিসাব করতে বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করে ফেল্‌ল সৈয়দ।

উজির, নাজির কোতয়াল আর ডাজ্ঞার বেড়ি পেরিয়ে এমপি সাহেবের দেখা পেতে রাত হয়ে গেল। ডানে বায়ে ২ জন বিশাল বপুর দাড়োয়ান সহ হাজী সাহেবের আগমন বৈঠকখনার চৌহাদ্দিতে নুরানী আলো ছড়িয়ে দিল যেন, বসন্তপুরের সৈয়দ আলী বোবা হয়ে গেল হাজী সাহেবের উচ্চতায়। ’তুই আবার কেডা? এত রাইতে কি চাস এইখানে?’। ’সাব, আমি বসন্তপুরের সৈয়দ, ইলিকশনের সময় আমার বাড়ির আংগিনা আপনার পায়ের ধূলায় ধন্য হয়েছিল। আমার ছোট মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করবেন বলে কথা দিয়াছিলেন, তাই হুজুরের দরবারে এই অধমের আগমন’। ইলশা হাজি একটা কিছু ভাবলেন, ’তা তোর মাইয়্যাডা কই, তারে আনছুস?’ একসাথে চকচকিয়ে উঠল হাজির চোখ আর জিহবা। কথা সংক্ষিপ্ত করে হাতে একশত টাকার পাচটা নোট ধরিয়ে ছোট মেয়েটাকে নিয়ে আসার জন্যে সমন জারি করল ইলশা হাজী। ’যা, মাইয়্যাডারে লইয়্যা আয়, ঢাকায় আমার গার্মেন্টস ফ্যক্টরীতে কাম আছে, সাথে তোর যাতি হবিনা, বায়জিদ বোস্তামী আগামীকাল সকালে ঢাকা যাইব, ভাল কইর‌্যা ছিনান করাইয়া মাইয়াডারে তুইল্যা দিস’। সৈয়দ আলীর চোখে পানি এসে গেল হাজী সাহেবের বদন্যতায়, পা ছুয়ে সালাম করে রওয়ানা দিল বসন্তপুরের দিকে।

সে রাতে বসন্তপুরের সৈয়দ আলীর বাড়িতে কেউ ঘুমাতে পারেনি। ডিম দেয়া মুরগীটা জবাই করে সবাই মিলে একসাথে রাতের খাবার খেল উঠানে বসে। জোৎস্নার প্লাবনে ভেসে গেল সৈয়দ আলীর আংগিনা, সাথে একটা রাতের জন্যে হলেও ভাসিয়ে নিল অভাব অনটনে বেড়ে উঠা কটা মানুষের দীর্ঘশ্বাষ।

সে যাওয়াই ছিল আইনুন নাহারের শেষ যাওয়া, তাকে আর কেউ কোথাও দেখেনি। শোনা যায় ইলশা হাজী আইনুন নাহারকে দিয়ে হরেক রকম বানিজ্য করাত, দেশী-বিদেশী অতিথির মনোরঞ্জন করিয়ে কোটি টাকার ব্যবসা আদায় করত। প্রথম প্রথম টাকা আসত ইলসা হাজীর বডিগার্ড বায়েজিদ বোস্তামীর হাত হয়ে, ধীরে ধীরে তাও বন্ধ হয়ে গেল। সৈয়দ আলী শূধু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে গেল তার সোমাত্তা মেয়েদের পরিনতি। নছিফাকে তুলে নিতে বর্ষারাতে মুখে গামছা এটে হাজির হল ইলশা হাজীর ছোট ছেলে কেয়ামতউল্লাহ্‌, গোলাক্তার গেল চেয়ারম্যানের দখলে। বছর না ঘুরতেই সৈয়দ আলী লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল। ইলশা হাজী আর মারফত চেয়ারম্যানের লোকেরা সৈয়দ আলীর লাশ তড়িঘরি করে কবর দিয়ে হারিয়ে গেল উজানী বিলে। পুলিশ এসে ছমিরন বিবিকে ধরে নিয়ে গেল স্বামী হত্যার অপরাধে।

এখানেই শেষ হতে পারত সৈয়দ আলীর কাহিনী, কিন্তূ তা হতে দেয়নি সৈয়দ আলীর স্ত্রী ছমিরন বিবি। ইলশা হাজীর এমপিগিরি পতনের সাথে সাথে ফেরারী হয়ে পালিয়ে যায় বিদেশে, স্থানীয় জনগণ লুটেপুটে নেয় হাজীর সম্পদ। ছমিরন বিবি বেরিয়ে আসে জেল হতে, তার সাহায্যে এগিয়ে আসে গঞ্জের মানবাধিকার সংস্থা। অনিশ্চিত ভবিষতের দুঃস্বপ্ন হতে উদ্বার করতে এগিয়ে আসে গ্রামীন ব্যংক। নাবালক দুই পুত্র নিয়ে ছমিরন বিবি শুরু করে নতুন এক জীবন, যে জীবনকে ছুতে পারেনি ইলশা হাজী আর মারফত চেয়ারম্যানের মত কুলাংগারের দল এবং তাদের কালো অপবিত্র টাকা।

উপসংহারঃ এটাকে গল্প বল্‌লেও ক্ষতি নেই। যে ভাবেই দেখেন না কেন, লাখ লাখ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে এ ধরনের সৈয়দ আলীদের খুজে নিতে খুব একটা কষ্ট করতে হবেনা আপনাকে, পাশাপাশি ইলশা হাজীদের ছায়াও আমাদের সমাজের সর্বস্তরে। বাস্তব ঘটনা হতেই গল্পটার সূত্রপাত, নাম এবং পরিচয় পালটে একে গল্পের রূপ দেয়া হয়েছে মাত্র। কাহিনীটার দু’টা দিক; প্রথমত, চরিত্রহীন রাজনীতি এবং এর ধারক বাহকদের নারকীয় কার্য্যকলাপ, দ্বীতিয়ত, পুরুষ শাষনের পাথর যুগীয় কদাচার হতে গ্রাম-গঞ্জের মহিলাদের মুক্তিতে গ্রামীন ব্যাংকের ভূমিকা। হতে পারে গ্রামীন ব্যাংক উচ্চহারে সূদ নিয়ে অঢেল পয়সা কামাচ্ছে, যে পয়সা মূলধন হিসাবে আবার ফিরে আসছে গ্রামের মানুষের কাছে। বেক্সিমকো কোম্পানীর নামে ২০০০ কোটি লুট করে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে মহিমান্বিত করেছেন জনৈক রহমান গুষ্টি, এ নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক মহল কেন জানিনা কথা বলতে পছন্দ করেন্‌না। পাশাপাশি নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ডক্টর মোহম্মদ ইউনুসের গ্রামীন ব্যাংক যেন রাজনীতির বৈমাত্রীয় ভাই, আর ডক্টর ইউনুস নিজে যেন ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে প্রবল প্রতাপশালী এক জেনারেল। এবার দেশে গিয়ে একটা জিনিষ জানতে পারলাম, গ্রামে-গঞ্জের হাজার হাজার মসজিদ মাদ্রাসার ইমাম মোয়াজ্জিনের দল প্রচন্ড ভাবে বিরোধীতা করছে গ্রামীন ব্যাংকের কর্মকান্ড। একজন টিপ্পনী কেটে জানাল, এই গ্রামীন ব্যাংকের ঋণ হুজুরদের পরাক্রমশালী রাজত্বে ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে। কথায় কথায় ফতোয়া দিয়ে গ্রামের সহায় সম্বলহীন মহিলাদের ভোগ করার সামন্তযুগীয় সাংস্কৃতিতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন।

কোনটা আমাদের কাছে বেশী গ্রহনযোগ্য, নিম্ন এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলাদের ইজ্জত নিয়ে ইলশা হাজীদের টানাটানি, না গ্রামীন ব্যাংকের উচ্চহারের সূদে ঐ পরিবারগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের লড়াই? বিচারের ভার আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন