ধর্ম-নিরপেক্ষতার সহজ সরল পাঠ।

Submitted by Visitor (not verified) on Saturday, October 24, 2009

সময়কাল ১৯৯০ সাল। সে বছর ইতালীতে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসতে যাচ্ছে। ব্যাপক সংখ্যক অবৈধ অভিবাসী অধ্যুসিত দেশটির বাহ্যিক ভাবমুর্তীর খাতিরে তখন লেজ্জে মার্তেল্লী বা মার্তেল্লী আইন ঘোষনা করা হয়েছে। এদেশে অবৈধ ভাবে বসবাসকারী অভিবাসীদের সাধারন এ্যামনেষ্টির মাধ্যমে স্থায়ী ভাবে বসবাস ও কাজের অনুমতি দেয়াই ছিল ঘোষিত এ আইনের মুল লক্ষ্য । আইনটি ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রধানত বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীন, ফিলিপিন, মরক্কো, তিউনিশিয়া ও আলজেরীয়ার ন্যায় দেশগুলীর লক্ষ লক্ষ রাজনৈতিক সরনার্থীরা এ সুবর্ন সুজোগ গ্রহনের উদ্দেশ্যে এখানে ছুটে আসেন। ঘোষনাটি আসার আগে সমগ্র ইতালীতে কম/বেশী মাত্র ৫০০ বাঙ্গালী ( যাদের মধ্যে সরকারীভাবে মাত্র ৩২৬ জন বৈধ ) অভিবাসী এ দেশটিতে ছিলেন, যাদের অধিকাংশের আবাস ছিল রোম শহরে আনুমানিক মাত্র ৪৫/৫০ টি এ্যাপরর্টমেন্ট বা ফ্লাটে। রাতারাতি এ সংখ্যা বেড়ে আনুমানিক প্রায় ছয় হাজার তথা বারো গুনেরও বেশী বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানে বসবাসকারী বাঙ্গালীদের দৈনিন্দন জীবনে এক প্রকট সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাঙ্গালীদের প্রতি ফ্লাটেই ৫০/৬০ জন মানুষ গাদাগাদি করে কোন প্রকারে রাত কাটাতেন। যাদের পরিচিত কেহ ছিলেন না কিন্তু সচ্ছল তারা বাধ্য হয়েই আবাসিক হোটেল গুলিতে অবস্থান নেন, অবশিষ্ট বিরাট সংখ্যক মানুষ রাস্তা, ঘাট, চার্চ ও মিউজিয়ামের বারান্দাতেই স্লিপিং ব্যাগ বা কম্বল মুড়ে কোন রকমে রাত কাটাতেন।

এমনি একটি সময়ে ইতালীর একটি ছোট্ট বামপন্থি রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেসিয়া প্রোলেতারীয়েত (ডি,পি) এর সহযোগীতায় আমরা সদ্য আগত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা, চীন ও ফিলিপাইনের এর অভিবাসনেচ্ছুদেরকে নিয়ে ইউনাইটেড এশিয়ান ওয়ার্কার্স এসোশিয়েশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলি। উদ্দেশ্য ছিল আইনের বেড়াজাল পেরিয়ে এখানে আগত সকলের বৈধতা অর্জন সহ দৈনিন্দন সমস্যা সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহন করা । কারন ঘোষিত মার্তেল্লী আইন অনুযায়ী ৩১ শে ডিসেম্বর ১৯৮৯ এর পুর্বে এদেশে প্রবেশ করেছেন এমন যে কোন প্রমান সাপেক্ষেই কেবল প্রত্যাশিত বৈধতার সোনার হরিনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে । অথচ এ ধরনের প্রমান দেখাতে ব্যার্থ হচ্ছিলেন অধিকাংশ অভিবাসনেচ্ছু, যেহেতু এদের অধিকাংশই উল্লেখিত দিনের পরই ইতালীতে আগমন করেছিলেন। সেজন্য এখানে আগত সকলের বৈধতা লাভের উপায় উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, গ্রুপ ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে আলোচনা ও তাদের প্রতি চাপ সৃষ্টিতে আন্দোলন এবং অন্যদিকে বিভিন্ন মানবতাবাদী দাতব্য সংগঠনের মাধ্যমে দৈনিন্দন থাকা, খাওয়া ও অন্যান্য সুজোগ সুবিধা আদায়ে আমরা বিভিন্নমুখী ততপরতা শুরু করি। কারিতাস দিওসেজানা, সান্তা-এজিডিও সহ বিভিন্ন চার্চ ও এনজিও সংগঠন ও রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি ও বর্নবৈষম্য বিরোধী ইহুদি ছাত্র সংগঠন গুলি তাদের সাধ্যানুযায়ী আমাদের বিভিন্ন সাংগঠনিক ও বৈষয়িক সহযোগীতায় এগিয়ে আসে। এরা পালাক্রমে কেহবা সকালের নাস্তা, কেহবা দুপুরের খাবার কেহবা রাতের খাবারের ব্যাবস্থা করেন,কেহবা এদের সামগ্রী (লাগেজ) সংরক্ষনের ব্যাবস্থা করেন। একটি প্রতিষ্ঠান সপ্তাহে একবারের জন্য ব্যাবহারিত কাপড় ধোয়া, ক্ষৌরী কর্ম, শীতকালীন জামাকাপড় এবং পাদুকা বিতরন ও স্নান সহ দুপুরের খাবারের ব্যাবস্থা করেছিল। মাত্র কয়েকদিনেই এ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটিতে প্রচুর লোক সমাগম বেড়ে গেলেও হটাৎ করে একদিন খবর এলো এ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট সেবাকর্ম স্থানীয় কমিউন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপে স্থগিত করা হয়েছে। এ ধরনের সেবা গ্রহনকারী প্রধানত বাঙ্গালী ও পাকিস্তানীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে এ সংস্থার অর্থসংস্থানকারী শ্রদ্ধ্যাভাজন পরিচালক ডন লুইজির সরনাপন্য হয়ে এর প্রতিকারের দাবি জানাতে তিনি স্থানীয় কমিউনের সাথে এ ব্যাপারে একটি যৌথ সভার ব্যাবস্থ্যা করেন। নির্ধারিত দিনে এ যৌথ সভায় উপস্থিত হলে আমাদের জানানো হয় যে, সপ্তাহের অন্যান্য দিন নিয়মিত ভিন্ন কর্মসুচী থাকায় সংশ্লিষ্ট এ প্রতিষ্ঠানটির সেবাদানের নির্ধারিত দিন ছিল শক্রুবার। সকাল দশটা থেকে ক্ষৌরী কর্ম, পোশাক-সামগ্রী বিতরন, গোসল ও মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ করে রোমের তৎকালীন একমাত্র কেন্দ্রীয় মসজিদে যেয়ে জুম্মার নামাজ আদায়ে ব্যার্থ হয়ে বেশ কিছু সেবাগ্রহনকারী মুসল্লী এ প্রতিষ্ঠানের কাটাতারের বেড়া কেটে পার্শবর্তী খোলা প্রান্তরে জামাতে নামাজ আদায় করে আসছিলেন। হটাৎ করে এ ধরনের সমাবেশের জন্য ঐ খোলা প্রান্তর ব্যাহারকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধ্যা ও শিশুরা এ ধরনের অপরিচিত ও তাদের ভাষায় উদ্ভট কর্মকান্ডে ভয় পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ও কমিউন কতৃপক্ষের গোচরে আনে। বিধায়, এ ধরনের মানবিক সেবাকর্মের বিরোধী না হলেও পুলিশের অনুমতি ছাড়াই খোলা চত্তরে এ ধরনের বে আইনী ও কতিথ উদ্ভট সমাবেশ বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যার্থতার জন্যই কতৃপক্ষ আইন অনুযায়ী এ ধরনের সেবা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছে বলে জানায়।

এ ধরনের অনাকাঙ্খিত ঘটনা শুনে আমরা যেমন বিব্রত হলাম তেমনি ধর্মপ্রান মানুষের নিষ্কলুষ প্রার্থনা সমাবেস শুধুমাত্র অপরিচিত বিধায় স্থানীয় মানুষের বীরূপতার শিকার হওয়ায় দারুনভাবে মর্মাহত হলেন নিষ্ঠাবান ধার্মীক ডন লুইজি। তিনি তৎক্ষনিক ভাবে সংশ্লিষ্ট চার্চের একটি অব্যাবহারিত সেমিনার কক্ষ নামাজ আদায়ের জন্য খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য তিনি আরো সিদ্ধান্ত নিলেন যে সকল ব্যক্তি শুধুমাত্র অপরিচিত বিধায় তাদের বীরূপতা প্রকাশ করেছেন,তাদের সাথে অভিবাসীদের জানাশোনা ও পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যাপ্তি বাড়াতে উৎসাহী এ সকল স্থানীয় ব্যক্তিদেরকেও এ সেবাকর্মের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এগিয়ে আসার আহবান জানানো হবে। এহেন আহবায়ন ও উদ্যোগের ফলে বেশ কিছু স্থানীয় যুবা,বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা ব্যক্তিবর্গ তাদের উদৃত্ত ব্যক্তিগত সামগ্রী,অর্থ ও সাধ্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এগিয়ে আসেন এবং অভিবাসীদের কর্মসংস্থানে সহায়তা করেন, এমনকি কিছু পরিবার বেশ কিছু অভিবাসীকে তাদের বাসস্থানে অস্থায়ী ভাবে থাকার ব্যাবস্থ্যা করেন।

ইতালীর জাতীয় অর্থনীতি,ধর্ম ও সমাজব্যাবস্থায় বৃহত্তর পরিসরে এশীয় অভিবাসীদের অন্তর্ভুক্তি সেই থেকে শুরু। ১৯৯০ এর লেজ্জে মার্তেল্লীর অধীনে বৈধাতাপ্রাপ্ত মাত্র চার হাজার পাচশত অভিবাসী বাঙ্গালীর সংখ্যা আজ লক্ষ্যাধীক। ইতালীয় নাগরিকদের ধর্মীয় ও সামাজিক সহিষনুতার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পেয়ে শুধুমাত্র রোম শহরে আজ আনুমানিক শতাধীক মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় হয়।

ইতালী, বিশেষ করে রোম নগরীর আপামর নাগরিকদের ধর্মীয় ও সামাজিক সহিষনুতার এ ব্যাপ্তি সৃষ্টিকারী আমার পরম শ্রদ্ধ্যেয় ডন লুইজি আজ আর নেই। নিজধর্ম প্রচারের সামান্যতম ও সহজলভ্য কোন পরলৌকিক মোহে ব্রতী না হয়ে, বরং নিছক মানবপ্রেম ও একজন নিষ্ঠাবান ধার্মীক ব্যাক্তি হিসেবে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের ধর্মীয় কর্তব্য পালনের প্রতি তার এহেন শাস্ত্রীয় আচরনকেই তো বলে ধর্মনিরপেক্ষতা। এটাকে ধর্মহীনতা বলার দুঃসাহস কার? এটাই আমার অভিজ্ঞতায় ধর্মনিরপেক্ষতার সহজ ও সরল পাঠ।
হাসান ইমাম খান,

সুইজারল্যান্ড।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন