চিন্তার দৈন্যতা বনাম বাক স্বাধীনতা!

Submitted by WatchDog on Sunday, October 4, 2009

দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছি মাত্র। আবেগের ডানায় চড়ে মাটি এবং মানুষকে বিচার করার বয়স পার হয়নি তখনও। এমনই একটা সময় এবং দিনের কথা। ট্রামে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি সোভিয়েত রাশিয়ার অন্যতম বড় শহর ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে। সন্ধ্যা হয় হয়। কাজ কর্ম শেষে সবাই ঘরে ফিরছে, শহরমূখী ট্রানস্‌পোর্টে তাই প্রচন্ড ভীড়। বসার সীট না পেয়ে ঠায় দাড়িয়ে আছি প্রায় ঘন্টাখানেক। প্রচন্ড বিরিক্তি আসছিল সবকিছুতে। হঠাৎ মার কোলে বসা ৪/৫ বছরের একটা শিশু চীৎকার করে বলে উঠল, ‘মা দেখ, একটা কালো বানর দাড়িয়ে আছে আমাদের সামনে’, আংগুল দিয়ে আমাকে দেখাল। ’বানরগুলো এমন কালো হয় কেন?’, এ জাতীয় প্রশ্নে মাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল শিশুটি। রুশ ভাষা ততদিনে নখদর্পনে, এর হাড্ডি কংকাল (গালাগালি) নিয়েও গবেষনার দিন শেষ। তাই শিশুটি কি জানতে চাইছিল বুঝতে সামান্যতম অসূবিধা হলনা। বয়সের কারণে এমন অবুঝ শিশুর মন্তব্যকেও সহজভাবে নিতে কষ্ট হল। ইচ্ছ হচ্ছিল জানালা দিয়ে ছূড়ে ফেলি মা-শিশু দু’জনকেই। সবচেয়ে কষ্টকর ছিল শিশুটির প্রশ্নে মার উত্তর শুনে। ‘ওরা নিয়মিত গোসল করেনা, তাই ওরা কালো এবং গায়ে গন্ধ‘, এ ভাবেই একে একে শিশুটির সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল তার মা। আশপাশের অনেক যাত্রী ভ্যা ভ্যা করে হেসে উঠল এ ধরনের রসাত্মক কথোপথন শুনে। আমার শীরদাড়া বেয়ে অজগর সাপের চলাফেরা অনুভব করছিলাম। প্রতিবাদ করে কোন কাজ হবেনা, তাই যন্ত্রণা হতে মুক্তি পেতে পরের ষ্টপেজে নেমে গেলাম।

অষ্ট্রেলিয়াতে সদ্য মাইগ্রেট করেছি মাত্র। বাস করছি সিড্‌নীর ইষ্টার্ন সাবার্ব ক্যান্সিংটনে। দু’টা মাস বেকারত্বের পর চাকরীর সন্ধানে নামতে হল বাধ্য হয়ে। বেঘোরে দরখাস্ত পাঠাতে শুরু করলাম। যেহেতু বিদ্যুৎ প্রকৌশলী, তাই শুরুটাও হল এ লাইন ধরেই। মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়, কাংখিত চাকরীর কোন খবর আসেনা। হাল ছেড়ে অন্য পথ ধরলাম, যে কোন প্রফেশনে হউক চাকরী আমার চাই। একটা ব্যাংকে লোক চাইছে, অভিজ্ঞতার দরকার নেই, তারাই ট্রেনিং দেয়াবে। ভাবলাম, এখানেই শুরু হউক আমার যাত্রা। দরখাস্ত জমা দিয়ে মনে মনে তৈরী হচ্ছি জয়েন করার। তিন সপ্তাহ পর একটা উত্তর পেলাম, ওদের হাওলায় আমার চাইতেও ভাল প্রার্থী আছে, তাই এ যাত্রায় হায়ার করা গেলনা। ভবিষতের আশ্বাষ দিয়ে আমাকে স্বান্তনা দিতে অবশ্য ভূল করলনা। দু’সপ্তাহ না যেতেই সিড্‌নী মনিং হেরালড্‌’এ একই চাকরীর জন্যে দেখলাম আবারও দরখাস্ত চাইছে। সইতে না পেরে ফোন করলাম। উত্তরে জানাল আমি না-কি ওভার কোয়ালিফাইড! এরপর আরও ৫টা বছর অষ্ট্রেলিয়ায় কাটাতে হয়েছে, এবং ভাল একটা চাক্‌রীর সন্ধানে শেষ দিনটা পর্য্যন্ত ব্যয় করতে হয়েছে গভীর তীতিক্ষায়। আমার এ ব্যর্থতার পেছনে লুকিয়ে ছিল প্রচ্ছন্ন বর্নবাদী মনোভাব।

আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষরা কথায় কথায় আমেরিকার গুষ্টি উদ্বার করতে কার্পন্য করিনা। সাম্রাজ্যবাদ, নব্য উপনিবেশবাদ, যুদ্ববাজ, মানবধিকার লংঘনকারী, মুসলমানদের শত্রু, এ জাতীয় বিশেষনগুলিতে ভূষিত করে দেশটাকে পৃথিবীর অন্যতম নিকৃষ্ট দেশ হিসাবে আখায়িত করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করিনা। বামজাতীয় একধরনের মানুষ এ তত্ত্ব উগীরনকে বেচে থাকার মাধ্যম হিসাবেই বেছে নিয়েছেন। এ শুধু আমাদের দেশের নয়, পৃথিবীর অনেক দেশের কাহিনী। উপরের কাহিনী দু’টোর অবতারনার কারণ হল, যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে যেদিন এদেশটায় প্রবেশকরি অর্থনৈতিক মন্দার পদ্‌ধ্বনী ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। তারপরও প্রথম চাকরীতে দরখাস্ত করতেই হায়ার করে নিল। আগেরটা বদলে নতুন একটা চাকরীতে ঢুকতে বিশেষ কোন বেগ পেতে হলনা। যদিও ইতিমধ্যে ৯/১১ ঘটে গেছে এবং বিভিন্ন কারণে চারদিকে মুসলমানদের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ দানা বাধছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে গভীর রাতে নিউ ইয়র্কের সাব-ওয়েতে চড়ে বাসায় ফিরছি। সামনের সীটের এক অর্ধমাতাল আমাকে দেখেই চীৎকার করে উঠল, শালা টেরোরিষ্ট! খুব একটা যাত্রী ছিলনা ট্রেনটায়। তবুও ২/১ জন প্রতিবাদ করল, কেউ একজন ৯১১’এ ফোন করে পুলিশকে অবহিত করল। পরের ষ্টেশনে ট্রেন থামতেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেল আধা মাতাল এই অতি আমেরিকান ইউরোপীয় অভিবাসীকে।

৯/১১’এর পরের দিনগুলোতে দেশ হতে ঘন ঘন ফোন পেতাম। আমার নিরাপত্তা নিয়ে সবাই চিন্তিত। নিশ্চিত করলেও কেউ বিশ্বাষ করতে চাইতনা। মা’কে ফোন করে প্রতিদিন নিশ্চিত করতে হত আমি ভাল আছি এবং আমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি। ৯/১১ ঘটনার পরপরই ম্যানহাটনে দেখতে যাওয়া হয়নি, গেলাম ২টা দিন পর। খুব একটা কাছে ভিড়তে দিলনা পুলিশ। জায়গাটার অনতিদূরে দাড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছিল, চারিদিকের বাতাস মানুষ পোড়া গন্ধে ভাড়ী, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। মাটিতে মিশে যাওয়া টুইন টাওয়ার দু’টির সামনে দাড়িয়ে দু’মনিটের জন্যে চিন্তাটা মাথায় এল; আচ্ছা, কি হত যদি একই কায়দায় ভারতের উগ্র সন্ত্রাসবাদীরা ঢাকার এসে বাংলাদেশ ব্যাংক অথবা জীবন বীমা ভবন দু’টি উড়িয়ে দিত! আমাদের দেশ কি হিন্দুর রক্তে ভেসে যেত? এ প্রশ্নের উত্তর চাইলে স্বদেশী অনেকেই চুপ হয়ে যান। এর কিছুদিন পরেই শেখ হাসিনা ঘুরে গেলেন এ দেশ এবং ঘোষনা দিয়ে যান বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে পরবর্তী আফগানিস্থান। এ দেশের মিডিয়াতে স্পেকুলেশন শুরু হয় ৯/১১ ঘটনার মূল ব্রেন ইজিÌিটয়ান ডাক্তার আইমেন আল জাওহারী বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। পরে অনেক্‌কে বলতে শুনেছি ক্ষমতাহারা আওয়ামী লীগ এমন একটা গসিপ মিডিয়াতে লেলিয়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারকে বিব্রত করার জন্যে। কে কাকে বিব্রত করতে সক্ষম হয়েছিল জানতে পারিনি, কিন্তূ এ দেশের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি হাসিনার ভিজিটের পর বাংলাদেশীদের তলব করতে শুরু করে দেয় তাদের অফিসে।

যুক্তরাষ্ট্র পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার অবিচল পূজারী। এখানে পূঁজিই নিয়ন্ত্রন করে রাষ্ট্র। এই পূঁজির স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে অনেক সময় এমন সব পদক্ষেপ নিতে হয় যা সাধারণ মানুষের দাবি এবং চাহিদার পরিপূরক হয়না। কিন্তূ তাই বলে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রের সব সিদ্বান্ত নীরবে মেনে নেয় এমনটা সত্য নয়। এ দেশের মানুষই ভিয়েতনাম যুদ্বের সবচেয়ে বেশী বিরোধীতা করেছিল। সমসাময়িক ইরাক যুদ্বের প্রতিও নেই এ দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের সমর্থন। গুয়ানতানা্‌মবে বন্দী শিবিরের বিরুদ্বে সোচ্চার এ দেশের অধিকাংশ মানুষ।

একটা সময় ছিল যখন রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিনীদের চরিত্রহননের সাথে গলা মেলাতে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করতাম। কিন্তূ একটা লম্বা সময় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় বাস করার ফলে সে উত্তেজনা ভাটা পরেছে। কথিত শ্রেনীহীন সমাজের যে রুগ্ন এবং পৈচাশিক চেহারা কাছ হতে অবলোকন করেছি, তাকে মূল্যায়ন করে মার্কিনীদের ঢালাওভাবে সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসনবাদ ইত্যাদী বিশেষনে ভূষিত করতে কোথায় যেন বাধে। হতে পারে পৃথিবীকে বুঝার এ আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতা। অন্য অর্থে এ আমার বাক স্বাধীনতা, যা শ্রেনীহীন সমাজে নিষিদ্ব ফলের মত।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন