ঘুরে এলাম গ্রান্ড ক্যানিয়ন - সম্পূর্ন

Submitted by WatchDog on Tuesday, September 29, 2009

grand canyon

কথা ছিল খুব সকালে বেড়িয়ে পরব। কিন্তূ বেরুতে বেরুতে দুপুর হয়ে গেল। এতদিন জানতাম বাংলাদেশী ললনারাই সাজ গোছের কারণে সব জায়গায় লেট, কিন্তূ আমার এই বিদেশী গৃহিনীও যে একই রোগে আক্রান্ত তা জানতে পেরে কিছুটা হলেও আস্বস্ত হলাম। ৫০০ মাইল (৮০০ কিঃমিঃ) যেতে হবে আমাদের, রাস্তায় বিশেষ কোন অসূবিধা না হলে প্রায় ৬ ঘন্টার উপর ড্রাইভ। ৩ মাস ধরে বেকার, কোথাও যেতে মন চায় না, পকেটের কথা ভাবলে আবার সাহষও হয় না। কিন্তূ এ যাত্রায় উপায় ছিলনা, গৃহিনীর ৩ দিনের ছুটি, ঘরে বসে এ তিনটা দিন কিছুতেই কাটানো যাবেনা, এমন ঘোষনা ১৫দিন আগ হতেই সাফ সুতর জানিয়ে দিল। আমিও ছিলাম মানষিকভাবে বিপর্য্যস্ত, তাই বিনা বাধায় এ যাত্রায় রাজী হয়ে গেলাম। গন্তব্যঃ প্রতিবেশী অংগরাজ্য আরিজোনার গ্রান্ড ক্যানিয়ন। প্রায় ৩ বছর হয়ে গেল আমেরিকার ওয়াইলড্‌ ওয়াইলড্‌ ওয়েষ্টে বাস করছি, অথচ গ্রান্ড ক্যানিয়ন দেখা হয়নি কথাটা কাউকে বল্‌লে বিশ্বাষ করতে চায়না। এমনটাই হয় বোধহয়, তা না হলে অষ্ট্রেলিয়ায় ৫টা বছর বাস করে আসলাম অথচ সিডনীর বাইরে ক্যানবেরা ছাড়া আর কোথাও যাওয়া হয়নি। ২০০১ হতে ২০০৬ পর্য্যন্ত বিরামহীন ভ্রমনে দেখা হয়েছে দক্ষিন আমেরিকার পেরু, বলিভিয়া, ইকুইডোর, কলম্বিয়া এবং মধ্য আমেরিকার কোষ্টারিকা, গুয়েতেমালা সহ পৃথিবীর অনেক দেশ। কিন্তূ দেখা হয়নি উত্তর আমেরিকার অনেক কিছু, যেখানটায় বাস করছি বছরের পর বছর ধরে। যাই হোক, ট্যাংক ভর্তি তেল নিয়ে শেষ বারের মত প্রথম আলো ব্লগে চোখ বুলিয়ে বেড়িয়ে পরলাম। প্রতিবারের মত এবারও ঈদে কাউকে ফোন করা হবেনা ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তবে হাইওয়েতে উঠতেই সে মনখারাপ বেশীক্ষন স্থায়ী হল না।

grand canyon

হাইওয়ে I-40 ধরে পশ্চিম দিকে রওয়ানা দিতে দুপুর ১টা বেজে গেল। আলবকুরকে শহরকে চারদিক হতে ঘিরে রেখেছে আদিবাসী আমেরিকানদের রিজারভেশগুলি। এখানটায় মেক্সিকান এবং আদিবাসীদের অলস চলাফেরা লক্ষ্য করলে যে কেউ এটাকে মেক্সিকো অথবা মধ্য আমেরিকার কোন শহরের সাথে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য। শহর হতে ১৮ মাইল দূরে গেলেই চোখে পরবে রেড ইন্ডিয়ানদের প্রথম উপস্থিতি। ক্যাসিনো ব্যবসার উপর নির্ভর করে আবর্তিত হয় এদের অনেকের জীবন, যা সরকারী পর্য্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় ঐতিহাসিক কারণে। যাই হোক, তাড়া থাকলেও রুট ৬৬ ক্যাসিনোতে ঢু মারার সিদ্বান্ত নিলাম দু’টো কারণে। এক, বিনামূল্যে হরেক রকম কোমল পানীয় পান, দ্বিতীয়, সন্মানিত সদস্য হিসাবে বেশকিছু প্রমো ডলার জমা আছে আমাদের একাউন্টে। কে জানে, হয়ত রুলেটে একটা দান বদলে দিতে পারে আমাদের বাকি জীবন। তেমন কিছুই ঘটল না, প্রমো ডলারের সব অংক খরচ শেষে ৭০ ডলার লাভ নিয়ে বেরিয়ে পরলাম ক্যাসিনো হতে। মোট সময় নষ্ট হল ১৫ মিনিট। শহরের শেষ চিহ¡ দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যেতেই নিজদের খুজে পেলাম র্নিজনতার বিষন্ন সমুদ্রে। কোথাও কিছু নেই, শুধু মাইলের পর মাইল সবুজ মাঠ, সাথে নেংটা পাহাড়ের ভৌতক স্তব্দতা। হাইওয়ে আই-৪০ খুবই ব্যস্ত রাস্তা, এ পথ ধরেই যেতে হয় নেভাদা অংগরাজ্যের লাস ভেগাস শহর এবং ক্যালিফোর্নিয়ার লস্‌ এঞ্জেলস্‌। ৪০ মিনিট পেরুতেই দেখা মিল্‌ল দ্বিতীয় ক্যাসিনোর। স্কাই সিটি ক্যাসিনোতে থামতে বাধ্য হলাম লাঞ্চের কারণে। পরবর্তী বিশ্রাম এলাকা ১০০ মাইল পর তাই রিস্ক নিতে সাহষ হল না।

ঈদের আগাম শুভেচ্ছা সহ ডালাস হতে বন্ধুর ফোন পেলাম। গ্রান্ড ক্যানিয়ন যাচ্ছি শুনতেই জিজ্ঞেষ করল পথে Arizona Petrified Forest National Park’এ থামছি কি না। GPS’এ লোকেশনটা চেক করতেই অবাক হলাম, নিউ মেক্সিকো বর্ডার হতে মাত্র ১ ঘন্টার ড্রাইভ। পার্কটার কথা আগেই শুনেছি, কিন্তূ এত কাছে তা জানতাম না। ২২৫ মিলিয়ন (সাড়ে বাইশ কোটি) বছর আগে আগ্নেয়গিরীর অগ্নুৎপাতের শিকার হয়ে পুরো ২৮ মাইল এলাকা তলিয়ে যায় জ্বলন্ত লাভার নীচে। সময়ের পরীক্ষায় পার্কের গাছগুলো রূপান্তরিত হয় পাথরে, যা দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে লাখ লাখ ট্যুরিষ্ট ভিড় জমায়। সাড়ে বাইশ কোটি বছর আগের কোন কিছু এত কাছ হতে দেখতে পাব ভাবতেই ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম।

হাইওয়েতে ড্রাইভ করার এ এক যন্ত্রণা, চারদিকের চোখ জুড়ানো দৃশ্যগুলোকে অন্ধের মত এড়াতে হয়। ৮০-৯০ মাইল বেগে (১২৮-১৪৪ কিঃমিঃ) গাড়ি চালাতে গেলে চোখ এদিক সেদিক করার কোন উপায় থাকেনা, সামান্য হের ফের হলেই আজরাইল বাবাজীর খপ্পরে ধরা দিতে হয় শেষ দোয়া না পড়েই। ঝকঝকে রাস্তা ধরে একনাগাড়ে ড্রাইভ করলে আরও একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, তন্দ্রা! যাই হোক, চারদিকের নয়নাভিরাম দৃশ্য, ঢুলু ঢুলু নিদ্রা এবং ডাইনাসোর সমান ট্রাক গুলোকে টেক্কা দিয়ে নিউ মেক্সিকো পার হয়ে আরিজোনা সীমান্তে পৌছে গেলাম অক্ষত অবস্থায়। পাহাড়ের কোল ঘেষে রেড ইন্ডিয়ানদের বিক্ষিপ্ত বসতি, মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজের ছড়াছড়ি আর রেঞ্চগুলোতে পশুদের অলস চলাফেরা; অন্ধের মত ড্রাইভ করলেও এগুলো এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় ছিলনা, এ সবের গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়।

grand canyon

হলব্রুক এবং নাভাখো এলাকার মাঝামাঝি ৩১১ এক্সিট ধরে হাইওয়ে হতে বেরিয়ে গেলাম। সরু রাস্তা ধরে কিছুটা পথ যেতেই পার্কে যাওয়ার গেট্‌টা চোখে পরল। ঘড়ির কাটা ইতিমধ্যে ৪টা অতিক্রম করে ফেলেছে এবং পার্ক বন্ধ হবে ৬টায়, একটু চিন্তায় পরে গেলাম সময় নিয়ে। ১০ ডলার এন্ট্র ফি দিয়ে ঢুকতেই খেয়াল হল নিউ মেক্সিকোর সাথে আরিজোনার এক ঘন্ট সময় পার্থক্য রয়ে গেছে, অর্থাৎ সময় এখন ৪টা নয় বরং দুপুর ৩টা। পার্কে ঢুকার সময় ধারণা ছিল হয়ত একটু এগুলেই সাড়ে বাইশ কোটি বছর পুরানো গাছগুলো চোখে পরবে। কিন্তূ বাস্তবে তা ঘটলনা, আমরা এগুচ্ছি আর দূরের পার্ক এবং পাহাড়গুলো যেন ততই পেছাচ্ছে। এ যেন গাধার নাকে মূলা বেধে সাহেবের শহর যাত্রা! একে একে ২৮ মাইল ড্রাইভের পর চোখের সামনে যে দৃশ্য ভেসে উঠল তা দেখে আমরা দু’জনেই স্তব্দ। একদিকে ভিন্ন রঙে সাজানো পাহাড়ের নৈশব্দিক বিশালতা, পাশাপাশি যতদূর চোখ যায় কোটি কোটি বছর আগের বিবর্তিত গাছের গোড়া। প্রথম টুকরাটা হাত দিতেই পরিস্কার হয়ে গেল ব্যাপারটা, বাইরে হতে একে গাছের টুকরা মনে হলেও ভেতরের সবটা জুড়ে আছে শক্ত পাথর। শুধু পাথর বল্‌লে ভূল বলা হবে, এ যেন শিল্পীর নিপুন হাতের ছোয়ার সৃষ্ট শিল্পকর্ম। হরেক রকম রঙের সমষ্টিতে কে যেন আল্পনা একে রেখেছে প্রতিটা গুড়িতে; লাল, নীল, বাদামী, ধূসর, কালো গুনে শেষ করার উপায় নেই।

grand canyon

বলা হয় প্রি-মিনেরালাইজড্‌ কাঠগুলো Aruacariaceae পরিবারের সদস্য যা উত্তর গোলার্ধে বিলীন হয়ে গেলেও দক্ষিন গোলার্ধের কয়েকটা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে টিকে আছে। Triassic যুগে (১৯৯ হতে ২৫১ মিলিয়ন বছর বিস্তৃত) এই এলাকাটা ছিল ট্রপিক্যাল আবহাওয়ার আওতায়। এক সময় প্রবল মৌসুমী বন্যা বনের গাছগুলো উপড়ে নিয়ে যায় নদীর মোহনায়। নদীর তীর জুড়ে বালু সমুদ্রে ডুবে যায় গাছগুলো। আর এই বালুতে প্রাধান্য ছিল লাভার ছাই, যাতে মিশ্রিত ছিল সিলিকা। এই সিলিকাই সয়াহক হিসাবে কাজ করেছে প্রি-মিনেরালাইজড্‌ বিবর্তনে। কোটি কোটি বছর ধরে লোহা এবং ম্যাংগানাইজের প্রভাবে গাছগুলোতে এসেছে রং’এর বিবর্তন। এভাবেই কেটে গেছে সাড়ে বাইশ কোটি বছর। মাটিতে শুয়ে থাকা গাছগুলোর সামনে দাড়ালে এক ধরনের ঠান্ডা অনুভূতি মগজকে গ্রাস করে নেয়, সাড়ে বাইশ কোটি বছর আগে কেমন ছিল আমাদের পৃথিবী? দেখতে কেমন দেখাত আমাদের অতীত বংশধরদের? এ সব প্রশ্নের উত্তর খোজার জন্যে এখানে প্রতিনিয়ত কাজ করছে আর্কিওলজিষ্টরা, সাথে আছে ইতিহাসবিদ এবং মনোবিজ্ঞানীর দল। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, এবার ফেরার পালা। কেন জানি মনটা খারাপ হয়ে গেল জায়গাটা ছেড়ে যেতে, এ যেন মার জড়ায়ু হতে নিজকে বিচ্ছিন্ন করা।

grand canyon

ঢুকার পথেই রেঞ্জারের দল হুসিয়ার করে দিয়েছিল গাছের গোড়া না কুড়াতে, ধরা পরলে জেল জরিমানা। কিন্তূ লোভ সামলাতে পারলাম না। যা হয় হবে এ ভেবে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে ছোট্ট একটা টুকরা পকেটে ঢুকিয়ে ফেল্‌লাম। ২২.৫ কোটি বছর আগের চিন্‌হ হাতে পাওয়ার এমন র্দুলভ সূযোগের লোভ সামলানো বেজায় কঠিন প্রতীয়মান হল। ফিরতি পথে ইয়া নফ্‌সি ইয়া নফ্‌সি ঝপে পার্ক exit’এ আসতেই দেখলাম মূল ফটক বন্ধ (অটোমেটিকভাবে খুলে যায় গাড়ি সামনে এলে)। রেঞ্জারদের গাড়ি চেক করার কথা, এ জন্যে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় দাড়িয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে হল। কিন্তূ কেউ এল না, ডানে বায়ে না তাকিয়ে দম নিয়ে চাপ দিলাম এক্সিলারেটরে। হাইওয়েতে ঢুকতেই স্ত্রীকে জানালাম চুরির ব্যাপারটা। হায় হায় করে উঠল সে, কিন্তূ টুকরাটা কেড়ে নিয়ে পকেটে ভরে ফেল্‌ল ক্রিসমাস ছুটিতে নিজ দেশে নিয়ে যাবে বলে। আমি শুধু কপাল হাতরালাম, কেন বড় একটা টুকরা চুরি করতে গেলাম না! ঢাকা মিউজিয়ামে দান করলে আমার নামটা নিশ্চয় শতাব্দি ধরে বেচে থাকত! চোর পালালে বুদ্বি বাড়ে! পার্কের রেশ কাটিয়ে ড্রাইভং’এ মন দিতে বেশ কিছুটা সময় লেগে গেল। ততক্ষনে পশ্চিম দিগন্তে সূর্য্যটা হেলে পরেছে, পাহাড়ের চূড়াগুলোতে নেমে এসেছে ভৌতক নীরবতা। পাশের সীটে গৃহিনী কখন ঘুমিয়ে পরেছে টের পাইনী, হাল্কা ভল্যিউমে বাউল সম্রাট আবদুল করিমের 'এই দুনিয়া মায়ার জালে বান্ধা' গানটা ছেড়ে দিয়ে হারিয়ে গেলাম পথচলার সমুদ্রে। পরবর্তী ঠিকানা গ্রান্ড ক্যানিয়নের কাছাকাছি ছোট্ট শহর Flagstaff।

NB: Theft
Theft of petrified wood has remained a problem despite protection and despite the fact that nearby vendors sell wood collected legally from private land. Despite a guard force of seven National Park Service rangers, fences, warning signs, and the threat of a $325 fine, an estimated 12 tons of the fossil wood is stolen from the Petrified Forest every year. Source: Wikipedia

হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে গেল যেন। পশ্চিম দিগনন্তে রক্তিম সূর্য্যটা মিলিয়ে যেতেই অন্ধকারে ঢেকে গেল যতদূর চোখ যায়। এতক্ষন ধরে রাজত্ব করা দানবীয় ট্রাকগুলোও ভোজবাজির মত হাওয়া হয়ে গেল হাইওয়ে হতে। ডান বায়ে যতদূর চোখ যায় জীবনের কোন ছোয়া নেই, শুধু পথ আর পথ, আকাবাকা এবং উচুনীচু। হাই বীমের হেডলাইট্‌টা লো বীমে নামিয়ে চারদিকের নীরবতাকে সন্মান জানালাম, বড্ড বেখাপ্পা লাগছিল এমন একটা স্বপ্নীল পরিবেশে এই চড়া আলোর বাড়াবাড়ি। গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলাম ভেতরের ভারী পরিবেশটাকে হাল্কা করব বলে। বাধ ভাঙা জোয়ারের মত বাতাসের শো শো শব্দ তচনচ করে দিল এতক্ষনের নীরবতা। প্রেইরী অঞ্চলের এই ভৌতিক নীরবতা সাথে বিনা নোটিশের কন কনে শীত আমেরিকার বন্য পশ্চিমের বৈশিষ্ট্য। ছোট বেলায় পড়া সেবা সিরিজ অনূদিত উপন্যাসগুলোর কথা মনে করে এক ধরনের তৃপ্তি অনুভব করলাম। বন্ধ করতে বাধ্য হলাম কাচের জানালাটা। ততক্ষনে মধ্য আকাশে চাঁদের দেখা মিল্‌ল, আকারে ছোট, কিন্তূ তাতেই ভাসিয়ে নিল প্রেইরীর জনশূন্য মাঠ ঘাট। কাব্যিক জোৎস্নায় দূর হয়ে গেল কিছুক্ষন আগের ঘুটঘুটে অন্ধকার। মনটা অকারনেই ভাল হয়ে গেল।

ফ্লাগষ্টাফ শহরটায় পৌছতে পৌছতে রাত ৯টা বেজে গেল। অনলাইনে হোটেল বুক করিনি ইচ্ছে করেই। জায়গায় পৌছে যাচাই বাছাই পূর্বক হোটেল পছন্দের ভেতর এক ধরনের ভোতা আনন্দ পাওয়া যায়, এ অনেকগুলো বছর ধরে ভ্রমনের ফসল। অবশ্য অনলাইন হতে প্রাথমিক একটা ধারণা নেয়া ছিল কোথায় খুজতে হবে। প্রথমে ঢু মারলাম বাটলার ষ্ট্রীটের উপর হোটেল 'রডেও ইন্‌'এ। যেমনটা ধারণা করছিলাম তাই হল, কাউন্টারে দেখা মিল্‌ল মধ্য বয়স্ক একজন ভারতীয়র। হিংসে হয় এ সব ভারতীয়দের দেখলে। মার্কিন মুলুকে তাবৎ মোটেল ব্যবসার মালিক এরা। টেক্সাস অংগরাজ্যের সান আন্তনিওতে যা দেখেছি এখানেও এর ব্যতিক্রম হল না। গোটা পরিবার মিলে ব্যবসাটা দেখাভাল করে থাকে। চোস্ত ভারতীয় উচ্চারনের ইংরেজীতে জানতে চাইল আমার প্রয়োজন। কাউন্টারে ঝুলছে ফ্রেমে বাধানো লাইসেন্স, ‘শ্রী হনুমান বালাজী এলএলসি‘র ব্যবস্থাপনায় চলছে এ মোটেল। রিশেপসেনিষ্ট নিজকে মাইক প্যাটেল বলে পরিচয় দিল, গুজরাটের সূরাত নগরীর বাসিন্দা। দুঃখের সাথে জানাল নন-স্মোকিং রুম খালি নেই, তাছাড়া রেট যা বলছে তার সাথেও এক হতে পারলাম না। বেরিয়ে পরলাম অন্য আরেকটার সন্ধানে। বেশীদূর যেতে হলনা, রাস্তার ওপারেই পাওয়া গেল ট্রাভেল্‌লজ নামের মোটেলটা। এবং আবারও সেই ভারতীয়। স্বামী স্ত্রী হাত দিয়ে রুটি সবজ্বি খাচ্ছে বিপদজনক তৃপ্তি নিয়ে, আমাকে দেখতেই একই উচ্চারনে স্বাগত জানাল। রুম পাওয়া গেল একটা, টেক্স সহ ৯৫ ডলার। ৩০-৪০ ডলারের রুম ছিল আমাদের টার্গেট, কিন্তূ স্মিতা সিং’এর সাথে আলাপ করে জানা গেল আজ শনিবার তাই হোটেল ভাড়া নিয়মিতের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। লম্বা জার্নির কারণে ক্লান্তি এসে বার বার জানান দিচ্ছিল, শরীরের সাথে কম্প্রোমাইজ করার ইচ্ছে হল না আর। নিয়ে নিলাম রুমটা।

ফ্লাগষ্টাফ হতে গ্রান্ড ক্যানিয়নের দূরত্ব প্রায় ৯০ মাইল (১৫৪ কিমি), এক ঘন্টার উপর ড্রাইভ। গরম পানিতে অনেকক্ষন ধরে গোসল করে মুছে ফেললাম শরীরের সমস্ত ক্লান্তি। হাল্কা পোশাকে বেড়িয়ে পরলাম রাতের খাবারের সন্ধানে। ’ড্যানি’ নামের চেইন রেষ্টুর‌্যান্টের সাথে আগে হতেই পরিচিত ছিলাম, তাই ঢুকে পরলাম বিনা দ্বিধায়। ভেতরে খদ্দেরের এতটা ভীড় হবে একেবারেই আশা করিনি। মধ্য সেপ্টেম্বরেও ট্যুরিষ্টদের আনাগোনার কোন কমতি মনে হল না, অন্তত রেষ্টুরেন্টের ভীড় দেখে। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ব্যয় হল ডিনার শেষ করে রেষ্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে আসতে। খুব সকালে বেরিয়ে পরতে হবে, তাই অন্যকোন এডভেঞ্চারে না গিয়ে সড়াসড়ি বিছানায় এলিয়ে পরলাম। পরবর্তী ঠিকানা গ্রান্ড ক্যানিয়ন।

কাল রোবাবার, এবং ঈদ। চাইলেও সহজে ঘুম এল না, সমুদ্র মহাসমুদ্র পেরিয়ে বাংলাদেশের ছোট জেলা শহরে আমাদের সেই বাড়িটার সৃত্মি বার বার সামনে এসে দাড়াল। ছোট বেলায় ঈদের চাঁদ দেখা নিয়ে আমাদের ছাদে হৈ হুল্লোর পরে যেত, কে আগে দেখছে এ নিয়ে সারা রাত তর্ক হত ভাইবোনদের মধ্যে। আর রেডিওতে উচু স্বরে ’রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ’ গানটা শোনার সাথে দাঁড়িয়ে যেত শরীর সবগুলো লোম, এ গানটার মাঝে খুজে পেতাম ঈদের আগমনী বার্তা, যার জন্যে বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতাম। মা-বাবা বেচে থাকলে পারতাম কি এমন একটা নির্বাসীত পরিবেশে ঈদের আগের রাতটা কাটাতে? এক ধরনের বোবা কান্নায় বুকটা ভারী হয়ে গেল। এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলাম টের পেলমা না।

রাজ্যের ক্লান্তি, তবুও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। জানালার পর্দাটা সড়িয়ে দিতেই সকালের র্মিষ্টি আলো ভাসিয়ে নিল হোটেল রুমটা। পাহাড়ের কোল ঘেষে সান্তা ফে রুটের মালবাহী ট্রেনটার হেলেদুলে চলা মনে করিয়ে দিল দাদা বাড়ির কথা। ’৭১এ যুদ্বের মাসগুলো এ ভাবে জানালা খুলে তাকিয়ে দেখতাম ট্রেনের আসা যাওয়া। খোলা মালগাড়িতে পাকিস্তানী সেনারা ট্যাংক কামান নিয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়াত গঞ্জের অলিগলিতে বয়ে যাওয়া লাইন ধরে। মাঝে মধ্যে বিনা কারণে গোলাগুলি করে প্রকম্পিত করে ফেলত চারদিক। শান্তি কমিটি এবং রাজাকারের দল সাড়িবদ্ব হয়ে স্বাগত জানাত তাদের অপকর্মের গুরুদের। ডিসেম্বর আসতেই বদলে গেল সে দৃশ্য, পাকিস্তানীরা দলে দলে পালাতে লাগল পাগলের মত। ৯ই ডিসেম্বরে উড়িয়ে দিল রেল লাইনের ছোট সেতুটা। কতই বা বয়স ছিল আমার! চোখ বুঝলে আজও ফিরে যাওয়া যায় সে দিনগুলোতে; জোৎস্নার প্লাবনে ভেসে যাওয়া সর্ষে ক্ষেতের আইল ধরে হাটছি আমি, অন্তহীন সে পথ। বাড়ি হতে মাইল খানেক দূরে ষ্টেশনে দাড়িয়ে থাকত মাল টানার ঘোড়াগুলো, খদ্দের না পেয়ে গঞ্জে ফিরে যাওয়ার মুখে চড়ে বসেছি একটা ঘোড়ায় অল্প কিছু সেলামীর বিনিময়ে। মনকাড়া প্রকৃতি আর কৈশোরের চাপা উত্তেজনায় মিশে সে যাত্রা মনে হত স্বর্গ যাত্রার মত। গোরস্থানের মোড়ে আসতেই নেমে পরতাম, বাকি পথ পায়ে হেটে বাড়ি পৌছে মিশে যেতাম ভাই-বোনদের ভীড়ে। বাবা কখনোই চাইতেন না ষ্টেশনের ধার কাছে যাই, তাই লুকাতে চেষ্টা করতাম আমার গোপন মিশন। এভাবেই কেটে গেল বেশ ক’টা মাস। ষ্টেশনে দাড়িয়ে চলমান ট্রেন দেখছিলাম একদিন, হঠাৎ থেমে গেল সৈন্য ভর্ত্তি ট্রেনটা। বিদ্যুৎ গতিতে ওরা নেমে এল, সামনে যাকে পেল জোড় করে তুলে নিল ট্রেনে। আমিও বাদ গেলাম না।

তন্ময় হয়ে মনে করছিলাম দিনগুলোর কথা। স্ত্রী পাশে এসে দাড়িয়েছে টের পাইনি। ‘ঈদ মোবারক‘! স্প্যনিশ উচ্চারনের শব্দটা মুহুর্তের মধ্যে আমাকে ফিরিয়ে আনল ২০০৯ সালে। আরে তাই ত, আজ না ঈদ! দ্রুত ফোন করে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের ঈদ মোবারক জানালাম। বেলা বাড়তে শুরু করেছে ইতিমধ্যে। স্ত্রী তাড়া দিল, বেরিয়ে পরতে হবে আমাদের। গোসল এবং হোটেলে ফ্রি ব্রেকফাষ্ট সেড়ে রওয়ানা দিতে প্রায় দশটা বেজে গেল।

রোববার সকাল, তাই হাইওয়ে ট্রাফিক ছিল হাতে গোনার মত। আবারও আই-৪০ ধরে পশ্চিম দিকে যাত্রা। সকাল হতে আকাশ জুড়ে মেঘের রাজত্ব, মাইল দশেক না এগুতেই আকাশের বাধ ভেঙে পরল যেন। ঝাপিয়ে বৃষ্টি এল। যতদূর চোখ যায় বৃষ্টি আর বৃষ্টি। এমন ভারী বৃষ্টিতে গাড়ি চালাতে অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। প্রাণ ভরে উপভোগ করলাম অনেকদিন পর দেখা পাওয়া মুষলধারের বৃষ্টি। বেশীক্ষন স্থায়ী হলনা এ আনন্দ, মিনিট দশেকের পথ পাড়ি দিতেই ভোজবাজির মত হাওয়া হয়ে গেল মেঘরাজ্য। গ্রীষ্মের ফক ফকা সূর্য্যটা যেন ওৎ পেতে অপেক্ষায় ছিল আমাদের। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলাম আশপাশে কাউকে না দেখে, ৯০ মাইল/ঘন্টা। ৩৫ মাইল পেরিয়ে ১৬৫ এক্‌সিটে বের হয়ে গেলাম আই-৪০ হতে। এরপর আরও ৬৫ মাইলের পথ। ঝকঝকে এক লেনের রাস্তায় গাড়ি চালাতে একটু বেখাপ্পা লাগল, সামনের স্লো গাড়িকে এড়ানোর রাস্তা বন্ধ। কিছুদূর এগুতেই বিপরীত দিক হতে ধেয়ে আসা গাড়িটা তিনবার হেড লাইট জ্বালিয়ে কি একটা বুঝাতে চাইল যেন। পুলিশ! নিশ্চয় সামনে কোথাও পুলিশ ওৎ পাতে আছে স্পীড মিটার নিয়ে। দু’মিনিট না যেতেই আমার সন্দেহ সঠিক হল, হাইওয়ে পেট্রোল পুলিশ মনিটর করছে গাড়ির স্পীড। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম পার হয়ে যাওয়া গাড়িটাকে। ৬৫ মাইল স্পীডের রাস্তায় ৮০ মাইল যাচ্ছিলাম এতক্ষন, বড় ধরনের জড়িমানা হতে বেচে গেলাম এ যাত্রায়।

গ্রান্ড ক্যানিয়ন যতই এগিয়ে আসছিল ভেতরের উত্তেজনাটা ততই বাড়ছিল। কিছুক্ষন পর পর হরেক রকমের বিলবোর্ড মনে করিয়ে দিচ্ছিল গন্তব্যস্থল হতে আমরা আর বেশী দূরে নই। দু’দিকের ঘন বন হতে সহাসাই হরিনের দল রাস্তা অতিক্রম করতে পারে এমন সাইন দেখা গেল যত্রতত্র। পুরো এলাকাটাই কেন জানিনা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ড হতে রটরোয়া পর্য্যন্ত লম্বা ড্রাইভের কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও নিউজিল্যান্ডের ও পথটা ছিল র্দুঘটনার শিকার পশুদের রক্তে একাকার, আরিজোনার এ পথটায় এমন কিছু চোখে পরলনা। দূর হতে আইম্যাক্স সিনেমা হলটা চোখে পরতেই বুঝে নিলাম পৌছে গেছি গন্তব্যে।

grand canyon

গ্রান্ড ক্যানিয়নঃ
৫৪ লাখ বছর আগে আরিজোনা অংগরাজ্যের কলোরাডো নদীকে ঘিরে গ্রান্ড ক্যানিয়নের সৃষ্টি। ক্যানিয়নের দৈর্ঘ্য ৪৪৬ কিলোমিটার এবং ক্ষেত্র বিশেষে এর প্রসস্ততা ৭ হতে ২৯ কিলোমিটার পর্য্যন্ত। উচ্চতা প্রায় ২ কিলোমিটার। ইউরোপীয় অভিবাসীদের আগমনের পূর্বে আমেরিকান আদিবাসীরা ক্যনিয়নের গুহা গুলোকে নিজদের আবাস হিসাবে ব্যবহার করত। বলা হয়ে থাকে স্পেনিশ সেনা সদস্য গারর্সিয়া লোপেজ দ্যা কারদেনাস ১৫৪০ সালে প্রথম বারের মত গ্রান্ড ক্যানিয়নকে ইউরোপীয়ানদের জন্যে আবিস্কার করেন। প্রেসিডেন্ট থেওডোর রুজভেলট গ্রান্ড ক্যানিয়ানকে সংরক্ষিত ন্যশনাল পার্ক হিসাবে ঘোষনায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

গ্রান্ড ক্যানিয়নের বিশালতা এবং এর দিগন্ত বিস্তৃত সৌন্দর্য্য কলম দিয়ে বর্ণনা করতে হলে থাকা চাই প্রকৃতি পাগল জাদরেল লেখকের গুন। আমি তেমন কেউ নই, তাই এর বর্ণনা সামান্য কিছুতেই সীমাবদ্ব রাখলাম । এ যেন প্রকৃতি এবং মানুষের সহাবস্থানের অন্তহীন সিম্ফোনী, যেন স্তব্দতার জালে আছন্ন এক স্বপ্নপূরী, যার শুরু এবং শেষ নিয়ে শুধু কল্পনা করা যায়, দেখা পাওয়া যায়না। স্লো মোশনে উড়ে যাওয়া চীলগুলোর দিকে তাকালে মনে হবে পৃথিবীটাও যেন পদানত এই পাখীগুলোর ডানার কাছে। যতদূর চোখ যায় শুধু ধূসর লালের মেলা, মাঝে মধ্যে হাল্কা মেঘ এসে গ্রাস করে নেয় ক্যনিয়নের চূড়াগুলো। এক একটা চূড়া মনে হবে তাজমহল, কুতুব মিনার, বৌদ্ব অথবা খ্রীষ্টানদের উপাসনালয়। এবং এদের সংখ্যা লাখ লাখ। সবচেয়ে দামী মুহুর্তটা বিমূর্ত হয়ে ধরা দেয় সূর্য্যাস্তের সময়। রক্তিম সূর্য্যের বিদায়ী আভা গ্রাস করে নেয় ক্যানিয়নের গভীরতা, মনে হবে কেউ যেন কোটি কোটি প্রদীপ জ্বালিয়ে উপাসনায় বসেছে। এ শুধু দেখার জিনিষ, অনুভব করার জিনিষ, বলার জিনিষ নয়। হাজার হাজার পর্য্যটক প্রকৃতির এই নয়নাভিরাম দৃশ্য ফ্রেমে আটকানোর জন্যে চাতক পাখীর মত অপেক্ষায় থাকে সাড়াটা দিন।

বেলা গড়িয়ে রাতের আধার গ্রাস করে নিল সবকিছু। এবার ফেরার পালা।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন