ক্রশফায়ার, রাজনীতির ব্যর্থতা না ব্যর্থতার রাজনীতি?

Submitted by WatchDog on Monday, September 7, 2009

Bangladesh Crossfire

প্রসংগটায় চক্ষু মেলার আগে দু’টো বাস্তব ঘটনা উল্লেখ না বলে পারছি না। অপ্রাসংগিক মনে হলে আগ বাড়িয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

ঘটনা ১:
আমাদের কাজের বুয়া, যাকে আমরা বাচ্চুর মা নামে গত ২০ বছর ধরে চিনি, কোন আগাম নোটিশ ছাড়াই হঠাৎ একদিন উধাও। প্রায়ই এ রকম করে থাকে, এ নিয়ে কথা বলার বিশেষ কোন সূযোগ নেই, কারণ মার কড়া হুকুম। যাই হোক, প্রতিবারের মত এ যাত্রায় অবশ্য বেশী দিন দেরী হলনা ফিরে আসতে। সবাইকে আশ্চর্য্য করে দিয়ে বাচ্চুর মা সাথে একটা জোয়ান বাছুর নিয়ে দু’দিন পরেই হাজির। বাছুর রহস্য নিয়ে প্রশ্ন করার আগেই সে হাউ মাউ করে কেদে উঠল, ’ভাইজানগো, আমারে বাচান, পুলাডার ৫ বছর জেল হইয়া য্যাইতাছে’। বাচ্চুর মা’র কথার সারমর্ম করলে যা দাড়ায় তা খুব সহজ; তার ১৯ বছরের ছেলে বাচ্চু রিক্সা চুরি করে এখন জেলে। মামলার রায় বের হতে যাচ্ছে পরের সপ্তাহে, দালাল মারফত বিচারক সাহেব খবর পাঠিয়েছেন এ যাত্রায় দশ হাজার টাকা না দিলে বাচ্চুর ৫ বছর জেল হয়ে যাবে। বাচ্চুর মা’র একমাত্র সম্বল এই বাছুরটা, বিক্রী করে টাকা যোগাড় করতে বাড়ি গিয়েছিল। ৪/৫ হাজার টাকার বেশী কেউ দিতে চাইছেনা, তাই এক রকম বাধ্য হয়েই বাছুর সহ আসতে হয়েছে।

ঘটনা ২:
শুক্রবার সকাল। পৌষের মিষ্টি সকালে বারান্দায় বসে পত্রিকার পাতা উলটাচ্ছি। ঢাকা হতে এক ভদ্রলোক এসেছেন কি একটা জরুরী বিষয়ে কথা বলবেন বলে। ইনিয়ে বিনিয়ে যা বললেন তার সারমর্ম হল; বাবা বেচে থাকতে মা’র নামে কি একটা ব্যবসা খুলেছিলেন এবং এর জন্যে বিদুৎ অফিসে একটা একাউন্টও খোলা হয়েছিল। বাবা মারা গেছেন অনেকদিন, এ ধরনের ব্যবসা আমাদের আদৌ ছিল কিনা তাও আমাদের জানা ছিলনা। যাই হোক, বকেয়া বিদ্যুতের বিল সূদে আসলে সোয়া লাখ টাকায় পৌছে গেছে এবং সময় মত বিল পরিশোধ করা হয়নি বলে মা’র নামে ঢাকার কোন এক মেজিষ্ট্রেট কোর্টে মামলা ঝুলছে। মামলার রায় আসন্ন, তাই বিচারক সাহেব সদয় হয়ে উনার ব্যক্তিগত সহকারীকে পাঠিয়েছেন একটা বোঝাপরায় আসতে। সোজা বাংলায়, বিচারককে ৫০ হাজার দিলে রায় যাবে আমাদের পক্ষে।

ক্রশফায়ারঃ
শব্দটা ইংরেজী, যার মোক্ষম বাংলা অনুবাদ আমার দৃষ্টিতে ’নির্জলা মিথ্যাচার’। বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্য্যায় হতে ছক বাধা সূরে শব্দটা নিয়ে মিথ্যাচার হচ্ছে। ‘অমুক মার্কামারা দাগী আসামীকে গ্রেফতার করে তমুক জায়গায় লুকানো অস্ত্র উদ্বারের জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, রাস্তায় গেরিলা কায়দায় অপেক্ষায় ছিল তার সহযোগীরা, শুরু হয় আক্রমন পালটা আক্রমন। সুযোগ বুঝে আসামী পালাতে চায়, র‌্যাব/পুলিশ বাধ্যহয় গুলি চালাতে, এবং মারা যায় অমুক এবং তমুক দাগী অথবা দাগীবৃন্দ। আজকাল এমন খবরের সবটুকু পড়তে হয়না, হেডলাইন হতেই বুঝা যায় পূরো খবরটায় কি আছে।

ক্রশফায়ার নাটকের রূপকার আজকের ক্ষমতাচ্যুত দল বিএনপি, এর যথাযত এবং নিবিড় ব্যবহার কর গেছে বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আওয়ামী লীগ, যারা নিজদের জনগণ এবং মুক্তিযুদ্বের স্বপক্ষের শক্তি বলতে মুখে ফেনা উঠাতে পারদর্শী, ক্ষমতার বাইরে বসে কঠিন ভাষায় সমালোচনা করত আইন বর্হিভূত এ ধরনের হত্যাকান্ডের। স্বভাবতই আশা ছিল দলটি ক্ষমতায় এলে বন্ধ হবে এ ধরনের মিথ্যাচার।
কিন্তূ তা হয়নি। শুধু তাই নয়, সাজানো হত্যাকান্ড নিয়ে দলটি একধাপ এগিয়ে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এ নিয়ে একেক মন্ত্রী একেক কথা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে একেবারেই বোবা। পাশপাশি দেশের বুদ্বিজীবি মহল, যারা ক্রশফায়ার নিয়ে বুদ্বির আগ্নেয়গীরি হতে নিয়মিত লাভা উদগীকরন করতেন, কি এক যাদু বলে র্নিবাক হয়ে গেছেন এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর হতে।

দু’মাস ধরে কিছুটা ভাটা ছিল ক্রশফায়ার নাটকে। এর ফাক ফোকর গলে দক্ষিন এবং দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলে আপরাধী চক্র কুক্ষিগত করে নিয়েছে এলাকার নিয়ন্ত্রন। হাট-বাজারের ইজারা, টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজী, রাজনৈতিক প্রাধান্য এবং নির্বাচনী রায় অনুকুলে আনা সহ আর্থিক ফায়দাগুলো নিজদের পক্ষে নেয়ার জন্যে সমাজের স্বীকৃত রাজনীতিবিদ এবং তাদের ধারক-বাহকেরা বিভিন্ন অপরাধী চক্রকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। আইনী লোকদের নষ্ট জড়ায়ুতেই জন্ম নেয় বেআইনী অপরাধ, এবং এ বেআইনী অপরাধকে র্নিমূল করার জন্যে ব্যবহার করা হচ্ছে ক্রশফায়ারের মত ততোধিক বেআইনী পন্থা। একথা কার জানা নেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাষী এবং চাদাবাজ হচ্ছে তার আইন রক্ষাকারী বাহিনী! আর আমাদের বিচার ব্যবস্থার কি বেহাল অবস্থা সেটা প্রমানের জন্যেই উপরের উদাহরন দু’টো টেনে এনেছিলাম। যে দেশে আইন এবং বিচার ব্যবস্থা বিক্রী হয় ওজন হিসাবে সে দেশের মানুষ অপরাধীদের স্বশরীরে নির্মূল করার ভেতর এক ধরনের স্বস্তি খোজার চেষ্টা করে, হোক তা আইনী অথবা বেআইনী পথে। সংগত কারণেই ক্রশফায়ারের প্রতি রয়েছে অনেকের নীরব সমর্থন। কিন্তূ এমন একটা সমর্থন বৈধ করেনা রাষ্ট্রের দায়িত্বে সংগঠিত অপরাধসমূহকে। ক্রশফায়ারের নামে এ ধরনের মধ্যযূগীয় বর্বরতা একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রের ব্যর্থতার করুন ছবি মাত্র, যার ছত্রছায়ায় লাভবান হচ্ছে আমাদের নষ্ট রাজনীতি এবং এর অন্ধ পূজারীর দল।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন