এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ৭ম পর্ব

Submitted by WatchDog on Wednesday, October 7, 2009

Andes Mountains - South America

অনিশ্চয়তার বেড়াজালে আটকে গেল ঘুমের পৃথিবী। এপাশ ওপাশ করেই কাটিয়ে দিলাম বাকি রাতটা। শেষ রাতের দিকে তন্দ্রামত আসতেই ঘড় ঘড় শব্দে বেজে উঠল এলার্ম ঘড়িটা। মিনিট খানেকের ভেতর রিসিপশন ডেস্ক হতে কেউ একজন ওয়েক-আপ কল দিয়ে জানিয়ে দিল এবার উঠতে হবে। রাজ্যের আলসেমী এসে ভর করলো শরীরের উপর। সাথে মাথাটাও ঘুরছে পাগলা ষাড়ের মত। উঠে পরলাম অনিচ্ছা সত্ত্বেও। বাথটাবে গরম পানি ছেড়ে শরীরটাকে ডুবিয়ে রাখলাম অনেকক্ষন। এত সকালে হোটেল ক্যান্টিন খোলা থাকবে কিনা সন্দেহ হল। ব্রেকফাষ্ট নিয়ে বেশ একটু চিন্তায় পরে গেলাম।

রুমের বিশাল পর্দাটা সড়াতেই এন্ডিসের চূড়ায় ঘুমন্ত সূর্য্যটার দেখা মিলল। ঘন কুয়াশা এবং খন্ড খন্ড মেঘের কোল ঘেষে শুয়ে থাকা লাল আভাটা উঠি উঠি করছে কেবল। হঠাৎ মনে হল সূর্য্যদয়ের এমন একটা মায়াবী দৃশ্য দেখেই বোধহয় বাকি দিনটা কাটিয়ে দেয়া যাবে, দরকার কি বলিভিয়া যাওয়ার! আবারও ফোন পেলাম রিসিপশন হতে, ক্যান্টিন খোলা হয়েছে, চাইলে নাস্তা করতে পারি। এলোমেলো চিন্তা সড়িয়ে বাস্তবে ফিরে এলাম। নাস্তা মিস করা যাবেনা। শুকনো দু’টুকরো রুটি, সাথে মাখন আর গরম এক কাপ কফি, এই ছিল হোটেলের ফ্রি ব্রেকফাষ্ট। নাস্তা সেড়ে রুমে ফিরে আসতেই বেশ তড়তাজা মনে হল নিজকে। লাগেজ গুছানো ছিল আগের রাতেই, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হলনা। সূর্য্য উঠার পর্বটা মিস করতে চাইলামনা এ যাত্রায়। সাথে একটা দূরবীন ছিল, ওটা নিয়ে দাড়িয়ে গেলাম জানালার পাশে। সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে মনে হল; কুয়াশা সাথে লড়ছে সূর্য্যটা, মাঝে মধ্যে বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে খন্ড খন্ড কালো মেঘ। পাহাড়ের কোলে চাইলেই দেখা যাচ্ছে সেই সব মেঘেদের ছায়া। কোটি কোটি সূর্য্য রশ্মি বাধ ভেংগে বেরিয়ে আসতে চাইছে মেঘ রাজ্যের মায়াবী বন্ধন হতে। ফাকে ফাকে উকি দিচ্ছে লাভার মত জ্বলন্ত সূর্য্যটা। বেশীক্ষন স্থায়ী হলনা এ অসম লড়াই। সূর্য্যের তীব্রতার কাছে ভেসে গেল মেঘমালার হাল্কা প্রতিরোধ। পাহাড়ের চূড়াগুলো বেরিয়ে এল কুয়াশার বুক চিড়ে। ধীরে ধীরে সকাল হয়ে গেল এন্ডিসের এ অংশটায়। রাতের পুনোকে চেনা গেলনা দিনের আলোতে।

যতই বেলা বাড়ছে সাথে বাড়ছে আমার টেনশন। দোভাষীনির দেখা নেই। কথাছিল ৮টার ভেতর বাস ষ্টেশন থাকব আমি। ঠিক ৮টা ১০’এ হাপাতে হাপাতে হাজির হলেন জনাবা। কথা না বলে শুধু ইশারা দিল, দৌড়াও। পরি মরি করে ছুটলাম বাস ধরতে। অনেকটা হিন্দী সিনেমার থ্রিলিং সিকোয়েন্সের মত মনে হল দু’জনের এ দৌড়। লাগেজ নিয়ে দৌড়ানো খুব একটা সহজ মনে হলনা। বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ট হতে এত উচুতে দৌড়াতে গেলে শ্বাষ ছোট হয়ে আসে, নাক মুখ হতে রক্ত বেরিয়ে আসে বিনা নোটিশে। কুলিয়ে উঠলামনা, তাই দৌড়ে হার মানতে হল দোভাষিনীর কাছে। বাসটা প্রায় ছেড়ে যাচ্ছে, অন্তিম মুহুর্তে পরিমরি করে কোনরকমে উঠে পরলাম। ততক্ষনে মুখ বেয়ে লালা পরতে শুরু করেছে, চাইলেও জ্বিহবাকে সঠিক জায়গায় ধরে রাখা যাচ্ছিলনা। হঠাৎ করে মারত্মক পিপাসা পেল। কিন্তূ তৃষ্‌না মেটাবার কোন কিছু সাথে আনা হয়নি, তাই নিজকে সান্ত্বনা দিলাম অবুঝ শিশুর মত। যেমনটা চেয়েছিলাম, জানালার পাশেই আমার সীট। একটু গুছিয়ে বসতেই চোখ গেল পাশের সহযাত্রীর দিকে। অত্যন্ত ধারালো এক সুন্দরী, বাশের মত লিকলিকে শরীর, টাইট জিনস্‌ এবং কোমরের অনেক উচু পর্য্যন্ত একটা হাল্কা টি-শার্ট। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম আমার ট্যুর গাইডকে।

আমার অবস্থা যাচাই করে হাই হ্যালো বলার আগেই ঠান্ডা এক বোতল কোমল পানীয় এগিয়ে দিল। লৌকিকতা করার মত অবস্থা ছিলনা, তাই কোন মতে হাল্কা একটা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘট ঘট করে গিলতে শুরু করে দিলাম পানীয়। ‘তুমি এন্ডিসের এ দিকটায় কি এই প্রথম?’, চোস্ত মার্কিন উচ্চারনের ইংরেজীতে জানতে চাইল তরুনী। ‘হ্যা, এই প্রথম, কিন্তূ তুমি জানলে কেমন করে? জিজ্ঞেষ করলাম আমি। উত্তরে যা বল্‌ল তা শুনে মাথা আমার চড়কগাছ। এ অঞ্চলে ভ্রমন করতে গেলে সাথে থাকা চাই যথেষ্ট শুকনো খাবার এবং পানীয়। অথচ আমার সাথে আছে কেবল ৪টা আপেল, তাও আবার কুসকো হতে কেনা। ’আমার নাম ভিক্টোরিয়া’, হাত বাড়িয়ে নিজের পরিচয় নিশ্চিত করল এই রহস্যময়ী। পেশায় একজন আইনজীবি, লুইজিয়ানা অংগরাজ্যের বেটেন-রুজ শহরে বাস। অবাক হয়ে গেলাম একজন আইনজীবির এ ধরনের পোশাক দেখে। সেও বুঝতে পারল বোধহয় আমার কনফিউশন। বত্রিশ দাত বের করে উত্তর দিল, ‘আমি ছ’মাস আইন প্রাকট্যিশ করি আর ছ’মাস ঘুরে বেড়াই মুক্ত বিহঙ্গের মত’, বেশ ঘটা করে প্রকাশ করল সে। নড়েচড়ে বসলাম আমি, জার্নিটা মনে হল বেশ লোভনীয় হতে যাচ্ছে।

Photobucket
Photobucket

-চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন