এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ১৫তম পর্ব

Submitted by WatchDog on Tuesday, October 20, 2009

Andes Mountains - South America

’বিয়েন বেনিদছ্‌ আ লা পাজ’, হাত বাড়িয়ে লা পাজে আমাকে স্বাগত জানাল কার্লোস। ’গ্রাসিয়াস সিনওর’, ধন্যবাদ জানিয়ে আমিও হাত বাড়িয়ে দিলাম। স্প্যনিশ ভাষায় জানতে চাইলাম তার নাম, এবং তাতেই সে ধরে নিল এ আমার ন্যাচারাল ভাষা। দক্ষিন আমেরিকা আসব বলে প্রয়োজনীয় ক’টা বাক্য রপ্ত করেছিলাম সেই নিউ ইয়র্ক বসেই, কিন্তূ কার্লোসের বকবকানির উত্তর দিতে গিয়ে সহাসাই আবিস্কার করলাম আমার স্প্যনিশের ভান্ডার একেবারেই ঠুন্‌কো। কিছুদূর এগুতেই জানিয়ে দিলাম, নো স্প্যনিশ por favor(প্লীজ)। বেচারা তাতে মোটেও দমে গেল বলে মনে হলনা, বরং বকর বকর আরও বাড়িয়ে কান ঝালাপালা করে ফেল্‌ল। উপায় না দেখে আমিও কথা বলার ষ্ট্রাটেজি বদলে ফেল্‌লাম, মিঃ হেরনান্‌ডেজের সাথে এখন হতে বাংলায় কথা বলব আমি! আমার সূদীর্ঘ ভ্রমন জীবনে অনেকবারই ব্যবহার করেছি এ কৌশল। মৌখিক যোগাযোগে ভাষার গ্যাপ থাকলে নির্জলা বাংলা ব্যবহার এক ধরনের ঐশ্বরিক তৃপ্তি এনে দেয়!

হাতের কাছেই সান ফ্রানসিস্কো প্লাজা, আমার ড্রাইভার-কাম-ট্যুর গাইড এখান হতেই শুরু করতে চাইল শহর ভ্রমন। খাঁটি বাংলায় বল্‌লাম, ’মিয়াভাই, ঘন্টাখানেক আগে ঘুরে গেছি এই স্কয়ার, যাওয়ার আর দরকার নাই‘। আগা মাথা কিছু না বুঝে গাড়ির দরজা খুলে আহ্বান জানাল সান ফ্রানসিস্কো কলোনিয়াল চার্চটা ঘুরে আসার জন্যে। না গেলে হয়ত ভূলই করতাম। দেখার মত জিনিষ। পরবর্তী ঠিকানা প্লাজা মুরিয়েয়ো। এই প্লাজার চারদিক ঘিরে আছে অনেকগুলো সরকারী ভবন, তারমধ্যে জাতীয় কংগ্রেস ভবন এবং প্রেসিডেন্ট ভবন অন্যতম। লন্ডনের ট্রাফলগয়ার স্কয়ারের মত শত শত কবুতর উড়ে বেড়াচ্ছে যত্র তত্র। খাবার দিলে ওরা হাতে, শরীরে বসে পর্যটকদের আনন্দ যোগায়। ট্যুরিষ্টদের ভীরে গিজ গিজ করছে স্কয়ারটা। বেশ ক’টা ছবি তুলে বিদায় নিলাম জায়েন ষ্ট্রীটের উদ্দেশ্যে। পথেই দেখলাম এভিনিউর নামটা, বুশ এভিনিউ। এবার আর বাংলা নয়, ভাংগা স্প্যনিশেই কার্লোসকে জিজ্ঞেষ করলাম, ’তে গুস্তা বুশ মুচঅ?’ অর্থাৎ, বুশকে কি তোমাদের খুব পছন্দ? পাহাড়ি খাদ বেয়ে উপরের দিকে উঠছিলাম আমরা, কায়দা করে গাড়িটাকে এক জায়গায় থমিয়ে কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল সে আমার দিকে, বিশ্রী একটা গালি দিল প্রেসিডেন্ট বুশকে, আমাকে সাবধান করে দিল লা পাজে এ ধরনের মন্তব্য করা হতে বিরত থাকতে। ভূলেই গিয়েছিলাম বলিভিয়া ভেনিজুয়েলান প্রসিডেন্ট হুগো সাভেজের সমাজতান্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত এবং এই নতুন কাষ্ট্রোর লোকাল এজেন্ট এবো মরালেসের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মাথা ঠান্ডা হতেই কার্লোস জানাল বুশ এভিনিউর নাম করণ করা হয়েছে আসলে তাদেরই এক জেনারেলের নামে, যার পূরো নাম খেরমান বুশ। দক্ষিন আমেরিকার রাজনীতি নিয়ে কথা বলার সময় এবং জায়গা এটা নয়, তাই চুপ করে থাকার সিদ্বান্ত নিলাম। তিওয়ানাকো কালচারের ওপেন-এয়ার মিউজিয়াম আমাদের পরবর্তী ঠিকানা। তারপর মেনুতে ছিল ওব্রাখেস, কালাকোতা এবং লা ফ্লোরিডা আবাসিক এলাকা ভ্রমন। মুন ভ্যালির মাটির ধ্বস দেখার মধ্য দিয়ে আমাদের ট্যুর শেষ হওয়ার কথা। কিন্তূ কার্লোস এখানেই থামলনা, আঁকাবাঁকা পথ ধরে পাহাড়ে ভাংগতে শুরু করল প্রচন্ড গতিতে। প্রথমেই থামল এমন একটা উচ্চতায় যেখান হতে পুরো লা লাজ শহরের প্যানোরমা দেখা যায় ফ্রেমে বাধানো ছবির মত। গাড়ি থামিয়ে সেও এগিয়ে এল আমার সাথে। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় আংগুল দেখিয়ে তাকাতে বলল আমায়। বিন্দুর মত দেখাল দূরের ষ্টেডিয়ামটাকে। এক ধরনের গর্ব খেলে গেল কার্লোসের চোখে মুখে। এই সেই বিখ্যাত ষ্টেডিয়াম যেখানে অনুষ্ঠিত হয় বলিভিয়ার ন্যাশনাল ফুটবাল স্পেক্টাকেল। প্রায় ভূলতেই বসেছিলাম আমি ফুটবাল পাগল দক্ষিন আমেরিকার কোন একটা দেশে এখন। সমুদ্র পৃষ্ট হতে পৃথিবীর যে কোন ষ্টেডিয়ামের চাইতে সবচেয়ে বেশী উচ্চতায় অবস্থিত এই ষ্টেডিয়াম। নাম শুনেছি অনেক, রাশিয়ায় থাকতে টিভিতে সড়াসড়ি খেলাও দেখেছি অনেকবার। কার্লোসকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। তাকে খুব একটা খুশী মনে হলনা ফুটবল নিয়ে আমার এই ভাবলেষহীন অভিব্যক্তিতে।

Photobucket

আমরা এগিয়ে গেলাম ট্যুরের শেষ গন্তব্যস্থল পরিদর্শনে। সান পেড্রো পাহাড়ের উপর কোচাবাম্বা এলাকায় ’ক্রেষ্টো দ্যা লা কনকরডিয়া’ ষ্ট্যাচু শহর হতে বেশ কিছুটা দূরে। যিশু খ্রীষ্টের এই মুর্তি ব্রাজিলের রিও দ্যা জেনেরোর ’ক্রাইষ্ট দ্যা রিডিমারের’ চাইতেও কয়েক ফুট লম্বা। প্রায় ৪১ মিটার লম্বা এটাই বিশ্বের সর্ব বৃহৎ যীশুর ষ্ট্যাচু। উচ্চতায় পৌছে গাড়ি থামতেই চোখ জুড়িয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে। খন্ড খন্ড মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে চারদিক। ইচ্ছে করলেই হাত দিয়ে ছোয়া যায় এক খন্ড মেঘ। বিশাল উচ্চতা হতে নীচে লোকালয়ের দিকে তাকালে রক্ত হীম হয়ে আসে। এত উঁচুতেও আলপাকা এবং জামাদের দেখা গেল এদিক সেদিক ঘুরাঘুরি করতে। ছবি তুললাম মন ভরে। হঠাৎ করেই বিশাল এক খন্ড মেঘ ঢেকে দিল মাথার উপরটা, চারদিকে নেমে এল এক ধরনের বোবা অন্ধকার। ভয়টা ভূতের মত চেপে বসল মাথায়! আমার হাতে দু’টা ভিডিও ক্যমেরা, একটা ডিজিটাল ষ্টীল ক্যমেরা এবং পকেটে অনেকগুলো টাকা। কি হবে যদি এই অজানা অচেনা ড্রাইভারের মাথায় লোভ চেপে বসে? হাল্কা একটা ধাক্কা দিলেই যথেষ্ট, ইতিহাস হয়ে যাব আমি এন্ডিসের বিপদজনক বাঁকে। বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম দরিদ্র এবং চরিত্রহীন দেশ, এখানে কাউকে বিশ্বাষ করাটা হবে বোকামীর শামিল। উঠে দাড়ালাম মুর্তিটার বিশাল পাদ্‌দেশ হতে। ড্রাইভার বল্‌লাম, ‘বামুস‘ (চল)। কোন অঘটন ছাড়াই পৌছে গেলাম হোটেলে। বিদায়ের আগে কার্লোসই জান্‌তে চাইল সকালে এয়ারপোর্ট যাওয়ার যানবাহন ঠিক করা আছে কিনা। ভাল কথা মনে করিয়ে দিল সে, ধন্যবাদ জানিয়ে তাকেই আসতে বল্‌লাম সকাল ৪টার ভেতর।

সন্ধ্যাটা এলোমেলো ঘুরে বেড়ালাম ডাউনটাউনে। মূল রাস্তায় এক মহিলা মুচির ছবি তুলতে গেলে তেড়ে এল মারতে, দৌড়ে আশ্রয় নিলাম পার্শ্ববর্তী হোটেলে। তবে এখানেই সমাপ্তি টানলামনা ভাল একটা দিনের। সন্ধ্যা নামার সাথে আবারও এন্ডিস হতে নেমে এল ঘন কালো কুয়াশা, ভোজবাজির মত কুয়াশার চাদরে ঢেকে গেল চারদিকের সবকিছু। অনেক সন্ধান অনুসন্ধানের পর একটা চীনা রেস্তোরা খুঁজে পাওয়া গেল বেশ কিছুটা দূরে। অষ্ট্রেলিয়ান এক দম্পতিকে সাথে নিয়ে অনেকদিন পর রাতের আহারে ভূরি ভোজ করলাম মনের আনন্দে। ৯টা বাজতেই চারদিকে বেজে উঠল হরতাল দামামা, তৈরী হচ্ছে লা পাজ কালকের জন্যে। আর কোন রিস্ক না নিয়ে ঘরে ফিরে গেলাম বিনা এডভেঞ্চারে। ১০টার ভেতর শুয়ে পরলাম খুব সকালে উঠতে হবে বলে।

ভোরে ঘুম ভাংগল ওয়েক-আপ কলে, নীচে ক্যাব নিয়ে অপেক্ষা করছে কার্লোস। হোটেল ভাড়া পরিশোধ করে যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। লা পাজ এয়ারপোর্টের চারদিকের বিস্ময়কর সৌন্দর্য্য বেশীক্ষন উপভোগ করার সময় পাওয়া গেলনা, চারদিকে হরতাল শুরুর চাপা উত্তেজনা। ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে পরলাম নিরাপত্তার কথা ভেবে। যাত্রী সহ ’লান চিলির’ ফ্লাইট আকাশে উঠতেই হাফছেড়ে বাচলাম, কিন্তূ মনটাও কেমন বিষন্ন হয়ে গেল সাথে। বিমানের জানালা ধরে তাকিয়ে থাকতে সেলুলয়েডের ফিতার মত রি-ক্যাপ হতে শুরু করল ফেলা আসা ২/৩ দিনের সৃত্মি। দেসাগুয়াদেরর অজানা আশংকা, এন্ডিসের অচেনা বাঁকে জীবন বাচানোর ম্যারাথন দৌড়, বিকট শব্দে বাসের চাকা পাংকচার, খাদ্য এবং পানি ছাড়া এন্ডিসের বাকে বিপদজনক বিকেল সহ টুকরো টুকরো অনেক ঘটনা। সবচেয়ে বেশী মনে পরল হারিয়ে যাওয়া রহস্যময়ী ভিক্টোরিয়ার কথা। সৃত্মির অলিগলি হাতড়াতে কোনদিন কি ফিরে আসা হবে পৃথিবীর এ প্রান্তে?

-আগামী পর্বে সমাপ্য।


ভালো লাগলে শেয়ার করুন