এন্ডিস পর্বতমালার বাঁকে বাঁকে - ১২তম পর্ব

Submitted by WatchDog on Thursday, October 15, 2009

Andes Mountains - South America

বেলা পরে আসছে, রওয়ানা হওয়ার উৎকণ্ঠা সবার চোখে মুখে। সূর্য্যাস্তের পর এন্ডিসের এ এলাকাটা মোটেও নাকি নিরাপদ নয়। বন্য হায়েনা আর অপহরনকারীদের অভয়ারন্যে পরিনত হয় অরক্ষিত মাঠ ঘাট । বলিভিয়া পৃথিবীর অন্যতম গরীব দেশ। র্দুনীতির হিংস্র থাবায় ক্ষতবিক্ষত এর রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো। সামরিক শাষনে দেশটির রয়েছে বিশ্ব রেকর্ড। এতগুলো বিদেশী পর্য্যটক এমন একটা অরক্ষিত এলাকায় আট্‌কে থাকা মানে অপহরনকারীদের মুখে খাবার তুলে দেয়ার মত, ব্যাপারটা ভাল করেই জানা ছিল ট্যুর গাইড্‌দের। চাকা বদল এবং ঠেলেঠুলে বাসটা রাস্তায় তুলতে প্রায় ঘন্টা খানেক পেরিয়ে গেল। ড্রাইভার জানাল বেলা অনেক গড়িয়েছে, যে পথ ধরে যাচ্ছি সে পথটা সামনে মোটেও নিরাপদ নয়। ফিরে যেতে হবে আসল পথে। রাস্তার অবরোধের তীব্রতাও নাকি কমে এসেছে ইতিমধ্যে। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্য্যন্ত রওয়ানা হলাম আমরা, তবে এ যাত্রায় পিছনমূখী। আমার কেন জানি মনে হল এ কাহিনীর কোন শেষ নেই, সামনে পেছনে করে অনন্তকাল ধরে চলবে আমাদের যাত্রা! নিয়তির কাছে নিজকে সপে দিয়ে বোবার মত গিলতে শুরু করলাম এন্ডিসের নৈস্বর্গিক স্তব্দতা।

আবারও সেই বিভীষিকা! সেই লৌমহর্ষক জায়গা!!! তবে গাড়ির সংখ্যা দেখে পরিস্থিতী সকালের মত ততটা জটিল মনে হলনা। গাইড এসে জানাল ভয়ের কিছু নেই, কিছু লেনদেন করতে হবে শুধু। তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লবী আন্দোলন! সবকিছুর শেষ মনে হয় একটা জায়গায় এসে, পকেট! চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশকে আবিস্কার করলাম মনে হল। বিছানো পাথরগুলো রাস্তা হতে সড়িয়ে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যে, যদিও বাঁশ জাতীয় কিছু একটা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে গোটা হাইওয়ে। হাতে লাঠি আর মাথায় লাল পটকার ’বিপ্লবী’রা সিংহের মত গর্জন করে বেরাচ্ছে, ইশারা পেলে ঝাপিয়ে পরতে মিনিট খানেক সময় নেবে বলে মনে হলনা। ডান হাতের ব্যাপারটা খুব দ্রুতই সম্পন্ন হয়ে গেল। গাইড্‌ জানাল দেসাগুয়াদে্‌রতে যাত্রী প্রতি ১০ ডলার উঠানো হয়েছিল এমন একটা আশংকার কারনে। এ মুহুর্তে কাউকে বিশ্বাষ করতে ইচ্ছে হলনা আমার। সবাইকে মনে হল একই চক্রের সদস্য, পর্য্যটকদের পকেট খসানোর সংঘবদ্ব নীল নক্সা।

দৈত্য-দানব আর রাক্ষস-খোক্ষসদের তান্ডব হতে মুক্তি পেলাম শেষ পর্য্যন্ত। সামনে নতুন কোন ঝামেলা নেই, এমনটা বলে ট্যুর গাইড আস্বস্ত করল আমাদের। সাড়াদিনের মধ্যে এই প্রথম বুক ভরে শ্বাস নিলাম, চোখ বুজে কল্পনা করলাম নিউ ইয়র্কের ছোট রুমটার কথা। আরও প্রায় ২ ঘন্টার পথ। পেছনের ঝামেলা মাথা হতে নামিয়ে যাত্রীদের অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পরল জানালার বাইরে রূপকথার এন্ডিসকে নিয়ে। আমি ভেজা মুরগীর মত ঝিমুতে শুরু করলাম। রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভীড় করল শরীরে। পাশের সীট্‌টা খালি, দু’পা উঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরলাম।

পাক্কা এক ঘন্টা পর ঘুম ভাংগল। সূর্য্যটা নেতিয়ে পরেছে ততক্ষনে। চারদিকে শুন শান নীরবতা। এন্ডিসের চূড়াগুলো ডুবে গেছে হাল্কা কুয়াশার কোলে। সূর্য্যের রক্তিম আভায় কুয়াশাগুলোকে আগ্নেয়গীরির রাক্ষুসে লাভার মত দেখাল। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাড়ি ঘরের চিন্‌হ দেখা গেল পাহাড়ের কোল ঘেষে। যতই এগুচ্ছি বাড়তে থাকল জনবসতির ঘনত্ব। সামনের সহযাত্রী জানাল ’বিপ্লবীরা’ মাঝ পথে আরও একবার বাসটা থামিয়েছিল, কি একটা কাগজ দেখাতে ছেড়ে দিয়েছে বিনা বাধায়। সহাযাত্রীদের জানার কথা নয়, কিন্তূ এই বাংলাদেশীর ভাল করেই জানা ছিল ঐ কাগজটার অর্থ এবং মূল্য কি। রাশিয়ায় পড়াশুনা শেষে ব্যবহারের জিনিষপত্র এবং একগাদা বই পাঠিয়ে ছিলাম জাহাজে করে। চট্টগ্রাম বন্দরের ঐতিহাসিক কালো অধ্যায় সমাপ্তি শেষে ট্রাকে করে ফিরিছি ঢাকায়। বন্দর হতে বেরুতে না বেরুতে পুলিশ বাহিনী আটকে দিল আমাদের যাত্রা। ড্রাইভার জানাল টাকা দিতে হবে। গাই গুই করে কাজ হলনা, পরিশোধ করতে হল পুলিশের ’পাওনা’। সব শেষ হতে একটা ক্লিয়ারেনস্‌ সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিল ড্রাইভারের হাতে। এটাই নাকি সেই যাদু-মন্ত্র যার বলে পার হওয়া যাবে সামনের সাত সমুদ্র তের নদী। ঘটনাটা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাষ বেরিয়ে এল। উত্তর আর দক্ষিন আমেরিকা, কাছের প্রতিবেশী দুই মহাদেশ, অথচ একেবারে উলটো তাদের জীবন যাত্রার মান!

ট্রাফিকের সংখ্যা দেখেই ধারণা করা যায়, আমরা প্রায় পৌছে গেছি। পাহাড়ের বিপদজনক শেষ বাকটা পার হতেই চোখে পরল শহরটা, লা পাজ। পাহাড়ি উপতক্যার খাদ ঘেষে থরে থরে সাজানো বাড়ি ঘর আর উচু দালান নিয়ে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে শহরটা। প্রায় ৮ লাখ লোকের বাস সমুদ্র পৃষ্ট হতে ৩৬৬০ মিটার উচ্চতার এই শহরে। পৃথিবীর সবচেয়ে উচুতম শহরের ভিত্তি স্থাপন করেছিল স্প্যনিশ দখলদাররা, সময়টা ছিল ১৫৪৮ সাল। এর আগে ইন্‌কাদের কাছে এলাকার পরিচিতি ছিল চকেয়াপো হিসাবে। গ্রামটার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চকেয়াপো নদীতেই প্রথম সোনা খুজে পায় উপনিবেশবাদীরা। ১৮৯৮ সালে লা পাজ’কে বলিভিয়ার এডমিনিষ্ট্রেটিভ রাজধানী হিসাবে ঘোষনা করা হয়। ১৯৬৪ সাল হতে ১৯৮০ সাল পর্য্যন্ত মার্কিনীদের সহায়তায় একটা পর একটা সামরিক অভ্যুত্থান ঘটতে থাকে দেশটায়। সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের উচ্চাভিলাস ব্যাহত করে বলিভিয়ার গণতান্ত্রিক যাত্রা। সোনা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েও দেশটার সাধারণ মানুষ কখনোই দারিদ্র সীমা হতে বেরিয়ে আসতে পারেনি।

সূর্য্যটা ডুবু ডুবু করছে প্রায়। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দেয়ার মত কন্টকাকীর্ন বিশাল এক পথ পাড়ি দিয়ে শহরের প্রবেশ মূখে ঢুকতেই পরিচিত দৃশ্যটা দেখে স্তব্দ হয়ে গেলাম। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা ফেলার বিশাল আয়োজন। সব বয়সের শিশু, নারী এবং পুরুষের দল পিঠে ঝোলা চাপিয়ে হুমড়ি খেয়ে হাতড়াচ্ছে আবর্জনার স্তূপ। উচ্ছিষ্ট নিয়ে শকুন, কুকুর আর মানুষের কামড়া কামড়িতে বিষাক্ত হয়ে উঠছে চারদিকের পরিবেশ। দারিদ্রের এমন কুৎসিত চেহারা দেখা হয়নি অনেকদিন। এক সময় ঢাকার প্রবেশ মূখ যাত্রাবাড়িতে দেখা যেত দারিদ্রের একই রূঢ় ছবি। পশ্চিম দুনিয়ার পর্য্যটকের দল হুমড়ি খেয়ে পরল ছবি তোলার জন্যে। আমি দু’চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলাম জন্মভূমিতে। বোমা বিস্ফোরনের মত ভয়াবহ শব্দে কেপে উঠল আমাদের বাসটা। অনেকের হাত হতে ছিটকে পরল ক্যামেরা। কিছু বুঝার আগেই ড্রাইভার জানাল পেছনের চাকা পাংচার। চাকা বদলানোর কোন আয়োজন নেই বাসটায়, অথচ মূল শহর এখনো মাইল খানেকের পথ। ’এবার তোমাদের নামতে হবে এবং নিজ খরচে স্থানীয় যানবাহন ধরে পৌছতে হবে শহরের কেন্দ্রবিন্দু সানফ্রান্সিস্‌কো প্লাজায়’, ট্যুর গাইড মৃত্যু ঘোষনার মত সংবাদটা প্রকাশ করে হারিয়ে গেল জনারন্যে।

- চলবে


ভালো লাগলে শেয়ার করুন