পদ্মাসেতু তদন্ত ও 'অপরাধী' ডক্টর মোহম্মদ ইউনূস পর্ব

Submitted by WatchDog on Saturday, December 1, 2012

Padma Bridge corruption

মোবাইল ফোনের রাজত্ব তখনও শুরু হয়নি। যোগাযোগ বলতে ট্রাডিশনাল ফোন আর চিঠিই একমাত্র ভরসা। তেমনি একটা সময়ের কথা। ফোনের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে গেল। রাত বাজে দুটা। দুঃসংবাদ না হলে এত রাতে কারও ফোন করার কথা নয়। ছ্যাঁৎ করে উঠল বুকটা। হূৎপিণ্ডের ধুকধুকানি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলাম রিসিভারটার উপর। বিরক্ত হলাম ও প্রান্তের গলার আওয়াজ শুনে। বন্ধুর ফোন। ঢাকা হতে কুষ্টিয়া যাওয়ার আগে অফিসে আমার সাথে দেখা করে গিয়েছিল। পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কি একটা টেন্ডারে অংশ নিতে কুষ্টিয়া যাচ্ছে। ফোনে যা বলল তা শুনে মেজাজ একেবারেই বিলা। ৩ লাখ টাকা দরকার তার, এবং তা যথা সম্ভব ভোরে। চাপ দিতে খুলে বলল ব্যাপারটা। টেন্ডার বিক্রি হচ্ছে এবং সকাল ১০ টার ভেতর ৩ লাখ টাকা নগদে পরিশোধ করলে নিশ্চিত পাওয়া যাবে এ কাজ। গ্রাউন্ড ওয়ার্ক নাকি ইতিমধ্যে শেষ করা আছে। বাকি শুধু লেনাদেনা। অনেকের কাছে মনে হতে পারে অলৌকিক, অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়কর। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যবসা বাণিজের উপর যাদের সম্যক ধারণা আছে তাদের কাছে এসব ডালভাত। বেঁচে থাকার জন্যে এসব খাদ্য আমাদের দৈনন্দিন মেনুতে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। ঘটনাটা এ রকমঃ দুপুর ১টার ভেতর নির্ধারিত বাক্সে দরপত্র ফেলে অংশগ্রহনকারীদের সবাই যে যার মত চলে যায়। কোন এক অদ্ভুত নিয়মে ঠিক করা হয় পরের দিন খোলা হবে এ বাক্স। আসলে এখানেই নাকি লুকানো ছিল তেজারতির আসল ধান্ধা। রাত ১০টার দিকে জানালা ভেঙ্গে পল্লী বিদ্যুতের কেউ একজন সীল করা রুমে ঢুকে পরে। তাকে অনুসরণ করে আমার বন্ধু। দুজনে মিলে পূর্ব প্রস্তুতি মোতাবেক খুলে ফেলে টেন্ডার বাক্স। অতিরিক্ত একটা দরপত্র বন্ধুকে আগ হতে বরাদ্দ করা হয়েছিল। টর্চের আলোতে একে একে সবকটা দরপত্র খোলা হয় এবং সর্ব নিম্ন দরদাতার চাইতে ১০০ টাকা কম কোট করে নতুন একসেট দরপত্র বাক্সে ফেলে সিলগালা মেরে একই পথে বেরিয়ে আসে দুজন। জানালা মেরামত করার জন্যে আগ হতে তৈরী ছিল বিশ্বস্ত একজন কাঠমিস্ত্রি। প্রফেশনাল লাইফের যতটা সময় বাংলাদেশে কাটিয়েছি তার কোন লেভেলেই একসাথে ৩ লাখ পাঠানোর মত সঙ্গতি ছিলনা। তাই এ যাত্রায় বন্ধুকে হতাশ করতে বাধ্য হলাম। অবশ্য সে যে খুব হতাশ হয়েছিল এমনটাও নয়। কারণ তার জানা ছিল আমার দৌড় হাজারের উপর নয়। কিন্তু জেনেও ফোন করেছিল বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে, ব্যবসা বাণিজ্যে তার লম্বা হাতের গর্বিত একটা চিত্র আমাকে উপহার দেয়া।

পদ্মা সেতুর দুর্নীতিতে সরকারের মনোভাব পরিবর্তন কেমন যেন সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। যে দুদক তদন্তের ২৪ ঘন্টার মধ্যে আবুলদের ফুলের মত পবিত্র সনদ দিয়ে সন্মানে ঠেকা দিয়েছিল, বিদেশি কজন বিগ গানের সফর শেষে তারাই আবার সুর পালটে ফেললো। ব্যাপারটা কেমন জানি অবাংলাদেশি লাগছে। এ দেশে অপরাধের চামড়া এতটা পুরো কামান দাগলেও তা প্রতিপক্ষের ষড়যন্ত্র বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। সোনা রফিক বলে কক্সবাজারের একজন এমপি ছিলেন। ভদ্রলোক মনে হয় ইন্তাকাল করেছেন এ বছর। সোনা চোরাচালানি পেশা হতে রাজনীতিতে ঢুকে সবকিছু পরিষ্কার করতে সক্ষম হলেও সময়মত নামটা পরিষ্কার করতে পারেননি। তাই মৃত্যুর পরও লোকজন তাকে সোনা রফিক হিসাবেই চেনে। এই রফিক সাহেব তত্ত্বাবধায়ক আমলে গুলসানের এক রেস্ট হাউজে একাধিক দেহপসারিনী সহ পুলিশের হাতে ধরা পরেছিলেন। বাংলাদেশের একজন সাংসদ শত কোটি টাকা আয় করবেন আর একাধিক নারী ভোগ করবেন না আমার মত অনেকের কাছে এটাও অবাংলাদেশি। সে যাই হোক, রফিক সাহেবদের শয়নকক্ষের খবর আমার লেখার উদ্দেশ্য না। উদ্দেশ্য হচ্ছে হোটেল কক্ষে বমাল ধরা পরার পর উনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা আলোকপাত করা। সাংবাদিকদের সামনে উনি জোর গলায় নিজেকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক হিসাবে দাবি করে বলেছিলেন হোটেল কক্ষে বেশ্যাদের উপস্থিতি নাকি বিরোধী দলীয় ষড়যন্ত্রের অংশ। টাকার বস্তা সহ ধরা পরে সুরঞ্জিত এন্ড গং’রাও দাবি করছে ষড়যন্ত্রের, রাজনৈতিক লীলাখেলার। আবুল মন্ত্রী, মসিউর উপদেষ্টা আর মোশারফ ভূঁইয়াদের মত রুই কাতলারাও দাবি করছেন উনারা ফুলের মত পবিত্র, আর মানি লোকের মান ইজ্জত নিয়ে খেলছে বিশ্বব্যাংকের মত নষ্ট প্রতিষ্ঠান। তাদের একজনকে দেশপ্রেমের সনদ ও জাতিসংঘের মত ফোরামে চৌদ্দগুষ্টি উদ্বারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জেহাদ ঘোষনা করলেন বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে। আমার মত অনেকে ভেবেছিল বিশ্বব্যাংকের বারোটা বাজল বলে! বিশিষ্ট সংবিধান বিশেষজ্ঞ বাবু সুরঞ্জিত সেনের কথা যদি বিশ্বাস করি আমাদের মানতে হবে বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে, কিন্তু শেখ হাসিনায় ধরলে ছাড়ে না। তো আমার মত অনেকেই আশা করেছিল আর্ন্তজাতিক এই সংস্থাকে সহজে ছাড়ছেন না আমাদের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু ভোজবাজির মত কেমন যেন সব পালটে গেল।

সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা চোর ধরতে বিদেশ হতে বিশেষজ্ঞরা এলেন এবং দুদকের কানে কিছু মন্ত্র দিয়ে গেলেন। ব্যাস, তাতেই কর্ম কাবার। উলটো সুরে কথা বলতে শুরু করেছেন শেখ হাসিনার গোলাম হোসেন। সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা আর আমলাদের তিনি ঘন ঘন তলব করছেন নিজ কার্যালয়ে, পাশাপাশি হুমকি দিচ্ছেন মামলা করার। কোথায় যেন কি একটা গোলমাল চলছে যা জাতি হিসাবে আমাদের জানতে দেয়া হচ্ছেনা। নিজস্ব সূত্র হতে পাওয়া ক্লাসিফাইড খবরে প্রকাশ, প্রধানমন্ত্রী আবুল আর মশিউরদের বলির বিনিময়ে দফারফা করেছেন বিশ্বব্যাংকের সাথে। এ যাত্রায় বেঁচে যাচ্ছেন নুরু রাজাকারের নাতি ও প্রধানমন্ত্রীর জামাই মশরুর হোসেন। সামনে নির্বাচন। অসময়ে হাড়ি ভেঙ্গে পরলে পদ্মা সেতুর ঝোলা হতে বেরিয়ে আসতে পারে হরেক কিসিমের বেড়াল। এসব বেড়ালদের চেহারা ভূমিকম্প তুলতে পারে ব্যালট নামক পানিপথের যুদ্ধে। তাই শেখ হাসিনা এ যাত্রায় রেহাই দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংককে।

এতদিন বলা হয়েছে বিশিষ্ট ’সুদখোর’ ডক্টর মোহম্মদ ইউনূসের কারণে নাকি পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেমে গেছে। নোবেলজয়ী এই ব্যাংকারের বিরুদ্বে অভিযোগ তিনি নাকি বিদেশী মুরুব্বিদের চেম্বারে দরজা আটকে কাতর হয়ে অনুনয় করেন বিনিয়োগ বন্ধের জন্যে। কিন্তু হায়, দুদক নিজ দরবারে সবাইকে সমন পাঠালেও কি এক অদৃশ্য কারণে তলব করছেনা ’মূল’ আসামিকে। তা যদি না-ই করবে তাহলে এই ব্যক্তির কাছে ক্ষমা চাওয়ার কি কিছু নেই হাসিনা-মুহিত গংদের? সংসদে দাড়িয়ে খোদ সাংসদরা দিনের পর দিন বেশাতি করে গেছেন প্রফেসর ইউনূসের বিরুদ্ধে। প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী সহ সরকারের বাকি প্রচারযন্ত্রের প্রায় সবাই এক বাক্যে দায়ী করে গেছেন বিশ্ববরেণ্য এই মানুষটিকে। কিন্তু তদন্তের কোন পর্যায়ে কেন এই ব্যক্তির নাম আসছেনা জাতি হিসাবে তা জানার অধিকার কি আমাদের নেই? নাকি আমরা সবাই হীরক রাজ্যের মূর্খ প্রজা, আর উনারা রাজাধিরাজ!

কুষ্টিয়া পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির টেন্ডার বিক্রির প্রসঙ্গটা এখানে শুধু শুধু টেনে আনিনি। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির সাথে এর কিছুটা হলেও যোগসূত্র আছে। খবরে প্রকাশ, টেন্ডার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই দরপত্রের একটা কপি হস্তান্তর করা হয়েছিল লাভালিনের টেবিলে। এবং বিনিময়ে দাবি করা হয়েছিল আকাশ সমান কমিশন। আবুল হোসেন, মশিউর রহমান, মোশারফ ভূইয়া আর মশরুর হোসেন সিন্ডিকেটের অস্বাস্থ্যকর মিলনের ফসল আজকের বিশ্বব্যাংক তদন্ত কমিশন। ওরা বিদেশি হয়ে দেশের মাটিতে চোর খুঁজছে, এর চাইতে লজ্জাজনক, অপমানজনক পরিস্থিতি বাংলাদেশকে ইতিপূর্বে কোথাও মোকাবেলা করতে হয়েছে বলে মনে হয়না। নির্লজ্জ এসব চোরের দলের সামান্যতম মূল্যবোধ থাকলে সমাজে বিচরণ করার কথা ছিলনা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, ওরা সুস্থ, সবল এবং প্রচন্ড শক্তিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজের সর্বক্ষেত্রে। এবং ওদের কাছেই বর্গা দিতে হচ্ছে আমাদের প্রতিদিনের জীবন। ধিক!

ভালো লাগলে শেয়ার করুন