খুন ও খুনের হাত-পা

Submitted by WatchDog on Sunday, November 30, 2014

এসব খবর কাউকেই আর চিন্তিত করেনা। ডাল দিয়ে ভাত খাবার মতই নিয়মিত হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। আমরা ফয়সালা করে নিয়েছি জীবনের সাথে। মেনে নিয়েছি এসব নিয়েই আমাদের জীবন। এভাবেই আমাদের বেচে থাকতে হবে। একটা সময় ছিল যখন চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করতো এসব ঘটনা। সমাজ সংসার নিয়ে যারা চিন্তা করতেন তাদের ভাবনার খোরাক যোগাত। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের মিয়াচর গ্রামে জনৈক করম আলী সরদার তিন দিন ধরে নিখোঁজ ছিলেন। পরিবারের সবাই চিন্তিত ছিল ৭৫ বছর বয়স্ক এ বৃদ্ধের অন্তর্ধানে। তবে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। তিন দিনের মাথায় পাওয়া গেল করম আলীর লাশ। শরীর হতে মাথাটা আলাদা করা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসরদের বিদায়ের ঊষালগ্নে যে মানুষের জন্ম তাকে পাওয়া গেল ধানের ক্ষেতে। নিথর হয়ে শুয়ে আছে। লম্বা জীবনের হিসাব চুকিয়ে ঠাঁই নিয়েছে প্রকৃতির কোলে। অথচ করম আলীর সব ছিল। ছিল সমাজ, সংসার, সন্তানাদি, মাথার উপর ছাদ আর দিগন্ত জুড়ে বিস্মৃত নীল আকাশ। কথা ছিল এ আকাশ আর বাতাসে থাকবে মুক্তির স্বাদ, স্বাধীনতার মৌ মৌ গন্ধ। কারণ ব্রিটিশদের পরেও আমাদের বিদায় করতে হয়েছে একদল রক্তলিপ্সু ভ্যম্পায়ারকে। বাতাস ভারী হয়ে আসছিল, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল জাতির। হয়ত সরিকল উপজেলার মিয়াচর গ্রামেও এ নিয়ে আলোড়ন উঠেছিল। হাতে অস্ত্র নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা না করলেও করম আলী সর্দার হয়ত বুক উঁচিয়ে গর্বের সাথে যোগ দিয়েছিল কোটি মানুষের কাফেলায়। অথচ ৪৩ বছর পর সে মিয়াচর গ্রামেরই কোন এক ধান ক্ষেতে লাশ হতে হল করম আলীকে। হয়ত একই ধান ক্ষেত যার আইল ধরে ৭১’সালে করম আলী উল্লাস করেছিল, মুক্তির উল্লাস।

আজ আমরা যে ক্রসরোডে দাঁড়িয়ে জীবনকে দেখছি সে জীবনের সাথে খুনের সম্পর্ক অনাদিকালের। সভ্যতা বিকাশের অবিচ্ছেদ্য অধ্যায় খুন। পৃথিবীর দেশে দেশে খুন হচ্ছে এবং পৃথিবী যতদিন সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকবে খুনও ঘুরবে পাশাপাশি। আক্কাস শিকদারদের অবস্থান কেবল বাংলাদেশে নয়। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে খুঁজলে তাদের পাওয়া যাবে। সম্পত্তির লোভ, অর্থের লোভ, হরেক রকম লোভের ঘোড়ায় চড়ে আক্কাস শিকদাররা আবির্ভূত হয়। স্বার্থের হিসাব মেলাতে গিয়ে করম আলী সর্দারদের লাশ বানায় এবং ফেলে রাখে নদী নালা খাল বিল অথবা ধান ক্ষেতে। তবে বাকি দুনিয়ার করম ও আক্কাসদের সাথে আমাদের কিছু মৌলিক পার্থক্য আছে। এবং এখানেই উদয় হয় হরেক রকম চরিত্র, হরেক রকম হিসাব নিকাস। আসুন কিছুক্ষণের জন্য হলেও ফিরে যাই গৌরনদীর মিয়াচর গ্রামে এবং পরিচিত হই জননী জন্মভূমির সাথে।

শিকদার এন্ড গংদের সাথে জমিজমা নিয়ে বিরোধের জের ধরেই করম আলীর মৃত্যু। জনাব আলীর লাশ ধান ক্ষেত হতে উদ্ধার করে বাড়ির উঠানে নিয়ে আসা হল। গ্রামের মানুষ মিছিল করে দেখতে এলো করমের লাশ। এবং শেষ বারের মত। খবর পেয়ে থানার এস আই ফোরকান আহমদকেও আসতে হল। হাতে খাতা কলম নিয়ে তাকে অনেক কিছু লিখতে হল। কোথায়, কিভাবে এবং কেন, লাশ নিয়ে এসব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হল সর্দার পরিবারের বাকি সবাইকে। থানায় আসার তাগাদা দিয়ে ফিরে গেল কর্মস্থলে। ফিরে গিয়ে দেখা পেল শিকদার পরিবারের। ওরা রুদ্ধকক্ষে সভা করছে ওসির সাথে। কত টাকায় দফারফা হবে তা নিয়ে দরাদরি চলছে। অগ্রিম বাবদ কত দিতে হবে এবং ফাইনাল রিপোর্ট দেয়ার পর কত এবং কিভাবে দিতে হবে তারও একটা ধারণা দেয়া হল। পরদিন নিহতের পুত্র বজলুর রহমানকে দেখা গেল থানার আঙ্গিনায়। ওসি সাহেব ব্যস্ত, তাই ঘন্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও দেখা মিললনা। পরদিন আবার আসতে হল। এবার আর একা নয়, সাথে থানার সাহেবের সোর্স। ওসি সাহেবের সাথে কথা বলে বজলুর বুঝতে পারলো খুন শিকদারদের কেউ করেনি, তাই তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবেনা। পুলিশ আসল খুনিদের বের করার জন্য তদন্ত করবে এবং সময় মত তাকে জানাবে। ভগ্ন মনোরথে বাড়ি ফিরে গেল বজলুর। সাহায্যের আশায় পরদিন ধর্না দিল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অফিসে। চেয়ারম্যান আশার বানী শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। এবং দেরী না করে রওয়ানা দিল থানার দিকে। ওসি এবং চেয়ারম্যানের মধ্যে গোপন বৈঠক হল। লেনদেনের অংক ফয়সালা করে চেয়ারম্যান ফিরে গেল নিজ ঠিকানায়। ঘটনা জানিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সাথে দেখা করল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। একান্ত নিভৃতে আলাপ হল। সাথে যোগ দিল থানা ও শিকদার পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য। সাংসদ সবাইকে চা বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। হাতবদল হল অনেক কিছু। সাংসদ নিশ্চয়তা দিলেন। শিকদার পরিবার নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে গেল। পরদিন বজলুরকে গ্রেফতার করতে থানা হতে পুলিশ এলো। মাদক ব্যবসার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হল। উপজেলার প্রেসক্লাবের সভাপতির সাথে শিকদার পরিবারের কত টাকা লেনদেন হয়েছিল পাঠকদের তা না জানলেও চলবে। কারণ তালিকা ধরে সবার অংক বের করতে গেলে ধৈর্যচ্যুতি ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। এ তালিকায় আদালতের বিচারক হতে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের অনেক রাঘব বোয়ালের নামও থাকতে পারে। মাস ঘুরে বছর গেল। বছর ঘুরে যুগ পেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। গ্রামের মানুষ ভুলে গেল এ গ্রামে করম আলী সর্দার নামে কেউ কোনদিন বাস করতো। আইন তার নিজস্ব গতিতে একদিন রায় দিন, আক্কাস শিকদার নিরপরাধ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তাকে ফাঁসানো হয়েছিল। বলাই বাহুল্য যে জমি নিয়ে এ খুন তা অনেক আগেই চলে গিয়েছিল আক্কাসের দখলে।

বাকি বিশ্বের খুনের সাথে আমাদের পার্থক্যটা বোধহয় এখানেই। একজন আক্কাস আলীর জরায়ু হতে জন্ম নেয় নতুন একজন খুনি। তার জরায়ু হতে আরও একজন। এভাবে চেইন রিয়েকশনের মত ছড়িয়ে পরে খুন। সন্তান খুন করে বাবাকে, বাবা খুন করে সন্তানকে, প্রতিবেশী খুন করে প্রতিবেশীকে, ব্যবসায়ী মস্তক আলাদা করে দেয় ব্যবসায়ীকে, সামান্য মোবাইল ফোনের জন্য বন্ধু খুন করে বন্ধুকে। পাশাপাশি রাজনীতি নামের ক্যান্সার মাকড়শার মত বিস্তার করে খুনাখুনির জাল। খুন ও খুনির আয়োজন, প্রয়োজন ও অভিনেতা অভিনেত্রীদের সবার জানা থাকে বাংলাদেশে খুন কোন সমস্যা নয়।

http://www.amadershomoys.com/newsite/2014/11/30/155788.htm

ভালো লাগলে শেয়ার করুন