রাশিয়ার পথেঘাটে - ২

Submitted by WatchDog on Wednesday, October 28, 2015

Russia

অবিরাম তুষারপাত চলছিল সে বছর। জানুয়ারি ফেব্রুয়ারির দাপট মে মাসেও কমার লক্ষণ দেখা গেলনা। বরফ আর বরফ। ধরণীকে মনে হল অমল ধবল পাল তোলা বিশাল একটা জাহাজ। ক্লান্ত, থেমে আছে কোন এক অচেনা বন্দরে। ডর্ম হতে ভার্সিটি ২০ মিনিটের পথ। তাও পায়ে হেঁটে। চাইলে ট্রাম ধরা যায়। পাতাল রেলেও যাওয়া যায়। তবে ভেতরে ঢুকা ও বের হওয়ায় যা সময়, হেঁটে গেলে তার আগেই পৌঁছা যায়। রুশ ছাত্রদের কেউ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ধরে না। ওরা হাঁটতেই পছন্দ করে। বিশেষ করে শীতকালটায়। এ সময় পাহাড় সমান তুষার স্তূপে তলিয়ে মেঠো-পথ। ছাত্রদের বাধ্য করা হয় বরফ সরিয়ে রাস্তা বের করতে। দুপাশের বরফ ভেদ করে শেষপর্যন্ত যে রাস্তা চলে যায় ভুল করলে তা মনে হবে জন-মানবহীন গুহা। মনে হবে সাইবেরিয়ার বরফাচ্ছন্ন কোন তুন্দ্রাঞ্চল, যেখানে লৌহমানব ষ্ট্যালিন স্বদেশীদের নির্বাসনে পাঠাতেন। হাঁটার সে পথে রুশরা অনেক সময় স্কি করে চলতে পছন্দ করে। ক্লাসে ঢুকার আগে বিশেষ একটা জায়গায় জমা করে যায় পায়ের স্কি। এমন সীমাহীন তুষার রাজ্যে আমরা বিদেশিরা চাতকের মত অপেক্ষায় থাকি বসন্তের। যেদিন বরফ গলতে শুরু করে কান পাতলে শোনা যায় তার আওয়াজ। বড় বড় বরফের চাক ধপাস করে মটিতে আছড়ে পরে। তৈরি করে মধুর এক শব্দ। আমরা বুঝতে পারি আরও একটা শীত বিদায় নিচ্ছে। কিন্তু সে বছর মে মাসেও তার কোন লক্ষণ দেখা গেলনা। টার্মের পরীক্ষা প্রায় শেষ। সামনে গ্রীষ্মের ছুটি। বিশেষ একটা কাজে আছে, তাই রওয়ানা দিলাম রাজধানী মস্কোর দিকে।

মস্কোতে শীতের প্রকোপ ততটা ভয়াবহ না হলেও দেখা গেল অন্য সমস্যা। বরফ গলে রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে আছে। সাথে ময়লার পাহাড়। রোববারটা বন্ধুর রুমে টিভি দেখে আর আড্ডা মেরে কাটিয়ে দিলাম। সোমবার সকাল সকাল রওয়ানা দিলাম নিজ কাজে। গন্তব্য রুশ ফেডারেশনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়। উদ্দেশ্য মন্ত্রণালয়ের সহকারী শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা করা। পৌছতে পৌছতে প্রায় ১০টা বেজে গেল। দর্শনার্থীর খাতায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম। মিনিট গড়িয়ে ঘণ্টা যায়, এক ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা। মন্ত্রীর দেখা নেই। তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত। সেক্রেটারিকে তৃতীয় বারের মত জিজ্ঞেস করতে কাটা মুরগীর মত হাউত করে উঠলো। বলল, অপেক্ষা করো আর পছন্দ না হলে রাস্তা মাপ। সেদিনের মত রাস্তা মাপলাম। একই ঘটনা দ্বিতীয় দিনেও ঘটলো। মন্ত্রী মিটিংয়ের ম্যারাথনে ব্যস্ত। দেখা হলোনা। তৃতীয় দিন সুযোগ দিতে চাইলাম না। তাই অফিস আওয়ারের আগেই হাজির। হাতে এক ঘণ্টা ফাঁকা সময়। সকালে কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই মন্ত্রণালয়ের ক্যাফেটেরিয়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। ওখানেও জনমানবশূন্য। একেবারে ফকফকা। শুধু ক্যাশিয়ার বসে আপন সীটে। হাতে ট্রে নিয়ে খাবার পছন্দ করতে যাবো এমন সময় দ্বিতীয় একজন ঢুকল। শুভ সকাল জানিয়ে হাতে ট্রে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আমার পেছনে। এক কথা দুই কথা... জিজ্ঞেস করল ভাগ্য কোন কারণে এত সকালে আমাকে এদিকটায় নিয়ে এসেছে। নিজের ক্ষোভ আর চেপে রাখতে পারলাম না। অনেকটা ঝাঁঝালো সুরে জানালাম নিজের হতাশার কথা। অভিযোগ করলাম মন্ত্রীদের এহেন কার্যকলাপ কোন ভাবেই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিপূরক নয়। পরিবর্তন হওয়া বাঞ্ছনীয়। আগন্তুকও সায় দিলেন আমার কথায়। একই টেবিলে নাস্তা সারলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দিলাম এক দৌড়। হুরমুর করে ওয়েটিং রুমে পৌছতে সেক্রেটারি জানাল মন্ত্রী কিছুক্ষণ আগে এসেছেন এবং তালিকার ১ম জন হিসাবে আমার সাথে কথা বলবেন। লম্বা একটা ধন্যবাদ দিয়ে দরজায় নক করলাম। ভেতর হতে ভারী গলার আওয়াজ পেতে ঢুকে পরলাম। একেবারে থ! ক্যাফেটেরিয়ার সেই আগন্তুকই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সহকারী মন্ত্রী!!!


ভালো লাগলে শেয়ার করুন