আমেরিকার হিংস্র পশ্চিমের গল্প

Submitted by WatchDog on Sunday, July 28, 2013

Wild west

যখন তখন ফিল্ড ট্রিপ আমার কাজের অংশ। গ্রাহকদের ফোন পেলে ডান বাম চিন্তা না করে দৌড়াতে হয়। শহরের মেয়র অফিস হতে শুরু করে অঙ্গরাজ্যের সিনেটরদের দুয়ার পর্যন্ত কড়া নাড়তে হয়। ছয়টা বছর ধরে শহর-বন্দর, পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি চষতে গিয়ে একটা সত্য উপলব্ধি করেছি গ্রাহকদের সন্তুষ্ট করার প্রফেশনালিজমে আমার কিছু ঘাটতি আছে। বেশিক্ষণ বাঁকা বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে পারিনা। রাগ চাপতে শুরু করে এবং মাথায় রক্ত উঠে যায়। ’কাষ্টমার অলওয়েজ রাইট’ বাক্যটা আমার কাছে মনে হয় এক ধরণের আত্মসমর্পণ, অন্যায়ের সাথে ফয়সালা করা। কিন্তু উপায় নেই, প্রতিযোগিতার বাজারে চাকরি ধরে রাখতে চাইলে কোম্পানীর কোড অব এথিক্স মেনেই চাকরি করতে হবে। চেষ্টা করছি কম্প্রোমাইজ করার অভ্যাস গড়ে তুলতে । এ কাজে অফিসের বাকি সবাই সহযোগীতা করে যাচ্ছে। হঠাৎ পাওয়া কল নয়, আগ হতে ঠিক করা ছিল। শহরের বাইরে যেতে হবে। দূরত্ব প্রায় ৩২ কিলোমিটার। ঠিকানা লাগুনা পুয়েবলো। ইন্ডিয়ান রিজারভেশন গুলো এ দেশে পুয়েবলো হিসাবে পরিচিত। ওখানে আমার জন্য অপেক্ষা করবে এ দেশের অন্যতম বড় কোম্পানী এটি&টি’র প্রতিনিধি জ্যাক লেমেলিন। এটি&টি নতুন একটা সেল টাওয়ার বসাতে যাচ্ছে পুয়েবলোতে। আমাদের কোম্পানী কাজ ফাইবার অপটিক ক্যাবল সরবরাহ করা। আমার কাজ ফিল্ড ট্রিপ ও ইঞ্জিয়ারিং ডিজাইন। জনমানবহীন মরুভুমির এক কোনায় অফিসের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছি। কেনেডিয়ান ফ্রেঞ্চ জ্যাকের দেখা নেই। আশেপাশে টাওয়ার নেই, তাই ফোনের সিগন্যাল দুর্বল। বার বার চেষ্টা করেও কো-অর্ডিনেশন ট্রেস করা যাচ্ছেনা জ্যাকের। এমন সময় দিগন্ত রেখায় ছোট্ট একটা বিন্দুর মত দেখা গেল গাড়িটাকে। পুয়েবলো ট্রেইল ধরে এগিয়ে আসছে সাদা রংয়ের সেডান একটা গাড়ি। নড়ে চড়ে বসলাম এবং খাঁটি বাংলায় এক গাদা গালি আউড়ে হাল্কা করলাম নিজকে। ভাবনাটা মাথায় ঢুকতে দমে গেলাম। সিডান গাড়িতে করে আসার কথা জ্যাকের। এর আগেও বেশ কয়েকটা সাইটে দেখা হয়েছে আমাদের। কোম্পানীর দেয়া বিশাল একটা সেমি ট্রাক নিয়ে চলাফেরা করে সে। দেখতে অনেকটা দানবের মত। ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। পুয়েবলোর এ দিকটায় প্রায়ই লাশ পাওয়া যায়। দুদিকে পাহাড়, সামনে যতদূর চোখ যায় সীমাহীন মরুভূমি। চারদিকে কয়োটি আর ক্ষুধার্ত শকুনদের অবাধ চলাফেরা। পুয়েবলো গুলোর উপর মার্কিন ফেডারেল সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই, স্টেট সরকার গুলোরও একই অবস্থা। মার্কিন আদিবাসীদের আছে তাদের নিজস্ব সরকার, পুলিশ বাহিনী। গাড়িটা যতই সামনে আসছে অস্বস্তিটা ততই বাড়তে লাগল। চিন্তাটা মাথায় আসতে স্ত্রীকে টেক্স করে জানিয়ে দিলাম আমার অবস্থান।

ঘ্যাচ করে থামল গাড়িটা। পুরানো নড়বড়ে চার দরজার শেভি ইম্পালা। চিন্তা ভাবনার সবকটা যন্ত্র মনে হোল ভোতা হয়ে গেছে। অনুভব করলাম গাড়ির ফুল এসির ভেতরও দর দর করে ঘামছি আমি। সামনে পিছে দুজন করে মোট চারজন ওরা। চেহারা দেখে অনুমান করে নিতে অসুবিধা হলোনা, লাগুনা রিজারভেশনের বাসিন্দা ওরা। অস্বাভাবিক মোটা, নাক মঙ্গোলিয়ানদের মত থ্যাবড়া আর গায়ের রং মেক্সিকানদের মত বাদামি। চোখে মুখে দরিদ্রের স্পষ্ট ছাপ। দুজন বেরিয়ে এলো। একজনের হাতে শটগান। ’হোয়াট দ্যা ফা* ইউ আর ডূয়িং ইন আওয়ার ল্যান্ড?’ মৃদু হাসি দিয়ে জানালাম ইউটিলিটি কোম্পানির প্রতিনিধি আমি, অঙ্গরাজ্যের জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সব জায়গায় যাওয়ার অধিকার আছে আমার। ’নট সো ফাস্ট মা*র ফা*র, দিস ইজ আ রিজারভেশন, রেস্ট্রিকটেড ল্যান্ড। ফ্রিওয়ে হতে বের হওয়ার মুখে কি বিলবোর্ডটি পড়নি? স্পেশাল পারমিশন ছাড়া এ এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। ’ওয়েল, আই এম ওয়ার্কি ফর ইওর ওয়েল বিং, পুলিং ফাইবার অপটিক টু ইউর ডোর। ’গেট লস্ট, উই ডোন্ট নিড ইউর সিটি অপটিক।’ কথার মাঝে গাড়ি হতে নেমে এলো তৃতীয় ব্যক্তি। অস্বাভাবিক মোটা। পা হতে মাথা পর্যন্ত টাট্টু। তার হাতেও শটগান। ’লং ষ্টরি শর্ট, গিভ মি ইউর ওয়ালেট’। দানবীয় হুংকারে ফেটে পরলো অতিকায় মানব। ’ইউর গভর্নর মে নট লাইক দিস, আই নো হিম পার্সোনালী’। কথাটা শুনে একটু দমে গেল মনে হল। নিজদের ভেতর কি নিয়ে যেন ফিস ফিস করলো। শটগান তাক করে একজন হুংকার দিল, ’উই উইল শ্যুট ইউ।’ হঠাৎ করে জিহ্বা শুকিয়ে গেল আমার। বাতাসের অক্সিজেনের পরিমান মনে হল স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের জন্য যথেষ্ট নয়। গভর্নরের প্রসঙ্গটা টানা ছিল ভুল, বুঝতে পেরে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ’ওকে গাইস, ফরগেট এবাউট গভর্নর, আই হ্যাভ সাম মানি এন্ড রেডি টু শেয়ার উইথ ইউ।’ পকেট হতে একশ ডলারের দুটা নোট দ্রুত গতিতে বের করে আনলাম। ওদের ভেতর এক ধরণের অস্থিরতা দেখা দিল। এন্টেনার কায়দায় চোখ ঘুরিয়ে কি যেন খোজার চেষ্ট করলো। হিংস্র নেকড়ের মত ছোবল মেরে ছিনিয়ে নিল নোট দুটো এবং চোখের পলকে মিলিয়ে গেল কাঁচা ট্রেইল ধরে।

উলটো দিকে তাকাতেই চোখ পরলো জ্যাকের উপর। পাকা শিকারির মত দাড়িয়ে আছে সে। হাতে জ্বল জ্বল করছে শটগানটা। ’এসব এলাকায় শটগান ছাড়া আসতে নেই। জীবন নিয়ে ফিরে যেতে চাইলে হাতে অস্ত্র থাকা খুবই জরুরি।’ মনে হল জ্ঞান হারাচ্ছি আমি। পানির গোটা বাকেটটা ঢেলে দিল মাথার উপর।

রাতে ঘরে ফিরতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন