ইসরাইল, ইহুদি রাষ্ট্রের একাল ও সেকাল

Submitted by WatchDog on Sunday, July 27, 2014

২০০১ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। মঙ্গলবার। এলার্মের কর্কশ আওয়াজে খুব সকালে ঘুম ভাঙ্গল। সূর্য উঠার আগে রওয়ানা দেয়ার প্লান ছিল। সে মোতাবেক আগের রাতেই সবকিছু গোছগাছ করে ছিল। ফিলাডেলফিয়ার জীবনে ইতি টেনে রওয়ানা দিচ্ছি বিগ আপেলের দিকে। ৩০নং স্ট্রীটের উপর ষ্টেশন হতে নিউ ইয়র্ক ঘণ্টা দেড়েকের পথ। মাইলের হিসাবে ৯৫ মাইল। ম্যানহাটনের ৮নং ষ্ট্রীট ষ্টেশনে বন্ধু রহমানের অপেক্ষা করার কথা। গোসল শেষে গায়ে কাপড় চাপানোর আগে ছেড়ে দিলাম টিভিটা। অদ্ভুত একটা দৃশ্যের দিকে তাক করা ছিল সিএনএন’এর ক্যামেরা। ম্যানহাটনের টুইন টাওয়ারের একটা বিল্ডিং হতে ঘন কালো ধোয়ার কুন্ডুলি উড়ছে। এক ধরণের দুর্ঘটনার আংশকা করছে সংবাদদাতা। খুব একটা পাত্তা দিলাম না খবরটায়। হরেক রকম ঘটনার লীলাভূমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দোকানে ঢুকে একশ ডলারে বন্ধুক কিনে এখানে বিনা বাধায় বের হওয়া যায়। এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করেনা। এমন একটা দেশে দুর্ঘটনা একেবারে ডালভাত। নিজস্ব সংবাদদাতা সন্দেহ করছেন হয়ত পথ হারিয়ে কোন যাত্রীবাহী বিমান ঢুকে পরেছে টুইন টাওয়ারের ভেতর। নিউ ইয়র্ক ফায়ার ডিপার্টমেন্ট খুবই শক্তিশালী একটি সংস্থা। তাদের পক্ষে মাইনর এ ধোঁয়া মোকাবেলা কোন ব্যাপারই না, এমন একটা চিন্তা মাথায় ঢুকতে শান্ত হয়ে গেলাম। সবকিছু প্রস্তুত জীবন যুদ্ধে নব অধ্যায়ের সূচনা পর্বে। সুটকেস হাতে নিয়ে বাতিটা নেভাতে যাব এমন সময় দেখলাম ঘটনাটা। বিশাল আকারের যাত্রীবাহী একটা বিমান আছড়ে পরছে দ্বিতীয় বিল্ডিঙটার উপর। দম আটকে গেল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হল। একি হচ্ছে! নিজের অজান্তেই হাত হতে সুটকেস দুটো খসে গেল। বসে পরলাম সোফাটার উপর। সাথে সাথে বেজে উঠল ফোনটা। রহমানের ঠান্ডা নিথর গলা। আজ আর নিউ ইয়র্ক আসা যাবেনা। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত রওয়ানা দিলাম নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে। তবে তিন দিন পর। চাকরির ট্রান্সফার কাগজ হাতে নিয়েই রওয়ানা দিয়েছিলাম মেগা শহরের দিকে। প্রথম দুটা দিন কেটে গেল লওয়ার ম্যানহাটনের দিকে ঘোরাঘুরি করে। খুব একটা কাছে যেতে দেয়নি ওরা। বাতাসের লাশের গন্ধ আর ধ্বসে পরা বড় বড় দালান গুলোর দিকে তাকাতে মনে হল এ যেন ছায়াছবিতে দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্তালিনগ্রাদ। তৃতীয় দিন যোগ দিতে হল কাজে। অফিস আদালত সহ জীবনের সর্বক্ষেত্রে ৯/১১’র প্রভাব। বুঝতে কষ্ট হয়না স্বাভাবিক জীবন থমকে গেছে এ শহরে। কুইনস বুলোভার্ডের উপর অফিস। নতুন জায়গা। রাস্তা-ঘাট বলতে কেবল চিনি সাবওয়ে। লাঞ্চের সময় প্রকট হয়ে দেখা দিল সমস্যাটা। হাতে ৩০ মিনিট সময় এবং কোথায় কি খেলে সময় মত ফেরা যাবে তার হদিস করতে কষ্ট হল। অফিস হতে বের হয়ে পেছনের দিকে বাঁক নিতেই চোখে পরল ট্রলিটা। ঠেলাগাড়িতে করে কেউ একজন হট-ডগ বিক্রি করছে। দামে সস্তা, তাৎক্ষণিক ভাবে তৈরি - লাঞ্চের সমীকরণ মেলাতে এর কোন বিকল্প মাথায় ঢুকল না। কিছুদূর এগুতেই চোখে পরল বিক্রেতার পশরা। খদ্দের বলতে আমার মত দুয়েক জন অফিস কর্মচারী। লোকটার চেহারা দেখে পরিচয় বুঝে নিতে পাণ্ডিত্যের দরকার হলনা। ওদের দশ মাইল দুর হতেও আমি চিনতে পারি। রুশ ইহুদি। কোন ভণিতা না করে তার ভাষাতেই শুরু করলাম পরিচয় পর্ব। হট-ডগের অর্ডার দিয়ে খোলা আকাশের নীচে পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে পরলাম।

সাবেক ইউক্রেইন প্রজাতন্ত্রের দনেস্ক অঞ্চলের মানুষ ভিতালি মিখেলসন। যৌথ কৃষি খামারের প্রধান প্রকৌশলী পদে থাকা অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে পালিয়েছেন। প্রথমে ইতালি, তারপর অনেক দেন-দরবার শেষে নিউ ইয়র্ক। ফেলে আসা মাতৃভূমির জন্য নূন্যতম মায়া, মমতা, সহানুভূতি অথবা নস্টালজিয়া দেখালেন না। আমি কোথাও চাকরি শুরু করেছি জেনে খুক করে হেসে ফেললেন। তার মতে আমার মত মাথা মোটা বোকারা-ই নাকি পরিশ্রম করে। পাশাপাশি তার মত চালাক চতুরদের জন্যই নাকি আমেরিকা। কথা প্রসঙ্গে জানালেন হট-ডগ বিক্রি একটা উপলক্ষ মাত্র। তার আড়ালে দুই পুত্র ও এক কন্যা নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন অবৈধ অর্থ কামানোর স্বয়ংক্রিয় মেশিন। এ মেশিনের নাট-বলটুর সবটাই নাকি এ শহরে বসবাসকারী ইহুদিদের হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। উপস্থাপিত চোরাই গলির বর্ণনা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একদিকে ৯/১১ এবং পাশাপাশি একজন ইহুদির অবৈধ আয়ের হিংস্র আস্ফালন। ভয় একসময় ক্রোধে রূপ নিলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে সময় মত কেটে পরলাম। ভদ্রলোকের সাথে আরও একবার দেখা হয়েছিল। তাও দুবছর পর। বিশাল একটা ক্যাডিলাকের মালিক। শহরের বিভিন্ন রাস্তায় গোটা দশেক হট-ডগ ট্রলি ভাড়া খাটান। স্বধর্মের দন্ত চিকিৎসকদের দালালি করেন। বিভিন্ন টোপ ফেলে রুগী নিয়ে যান চিকিৎসকদের দুয়ারে। তারপর শুরু করেন ইনস্যুরেন্স তেলেসমাতি। পাশাপাশি অপরিচিত ইহুদি ফাউন্ডেশন হতে আর্থিক সাপোর্ট আদায় করেন মিথ্যা তথ্য দিয়ে। সানি সাইডে তিন তলা বাড়ি কেনার প্রসঙ্গ তুলে অট্টহাসিতে ফেটে পরলেন।

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইউরোপে নাৎসিবাদের কেন অভ্যুদয় ঘটেছিল এর অনেক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। এর উপর গবেষণা এখনো চলছে। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এক যুগ বাস করার পর আমি নিজের জন্য একটা কারণ দাঁড় করিয়েছি। তাদের শুরুটা ছিল নিউ ইয়র্কের মতই। সুঁই হয়ে ঢুকে সাপ হয়ে বের হওয়ার নীলনকশা খুব সফল ভাবে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল তারা। শুরুটা ছিল অর্থনীতি দিয়ে। জন্মগত গুণাবলির সাথে স্বজনপ্রীতির নেটওয়ার্ক মিশিয়ে এক থাবায় কব্জা করে নেয় জার্মান অর্থনীতি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও জনসংখ্যার বাকিরা বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হতে থাকে। এ বঞ্চনার সূতিকাগারে এক সময় জন্ম নেয় ক্ষোভ। অষ্ট্রিয়ায় জন্ম নেয়া হিটলার ক্ষোভের বারুদে কেবল আগুন জ্বালিয়েছিলেন। এবং তাতেই বিস্ফোরিত হয়েছিল নাৎসি জার্মানি। তচনচ হয়েছিল এতদিনের সজানো বাগান। গোটা জার্মানি জড়ো হয়েছিল হিটলারের পেছনে। তার অন্যতম কারণ ছিল অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং সীমাহীন স্বজনপ্রীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ বুঝতে পেরেছিল তাদের সমস্যা কোথায় এবং কারা। এবং তা সমাধানের জন্য জাতিসংঘ নামক আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম দিয়ে তার ঘাড়ে বন্দুক রেখে জন্ম দেয় ইসরাইল নামক রাষ্ট্রের। ইউরোপ হতে ঝেটিয়ে বিদায় করে ফেলে ইহুদি ক্যান্সার।

দুর্ভাগ্য আরবদের। ব্রিটিশ প্রভুদের দাসত্ব করতে গিয়ে গলার ফাঁস হলেও মেনে নিতে হয় ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব। ৬৭ সালের এক সপ্তাহের যুদ্ধেই বেরিয়ে পরে আরব জাতীয়তাবাদের আসল চিত্র। ১৯৬৭ হতে ২০১৪, এ ফাঁকে প্যালেস্টাইনের মাটিতে অনেক রক্ত ঝরে গেছে। পাশাপাশি ভোতা হয়ে গেছে বিশ্ব বিবেক। এক সপ্তাহের যুদ্ধে আজ সেখানে হত্যা করা হয়েছে দুই হাজার প্যালেস্টাইনী। যার বেশির ভাগই শিশু ও মহিলা। বিশ্ব বিবেকের কোথাও এতটুকু হেরফের হচ্ছেনা এ গণহত্যায়। এখানেও কাজ করছে নাৎসি পূর্ব জার্মানির ইহুদি তত্ত্ব। এ যাত্রায় এ তত্ত্বের লীলাভূমি হিসাবে কাজ করছে আটলান্টিকের এপারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গেল শতাব্দীর ত্রিশ ও চল্লিশ দশকে জার্মানিতে যা ঘটেছিল একই ঘটনা ঘটছে আজকের যুক্তরাষ্ট্রে। ওদের দখলে চলে গেছে দেশটার অর্থনীতি। যার নিয়ামক শক্তি হিসাবে কাজ করছে প্রচার মাধ্যম। আজকের আমেরিকায় সাহসী এমন একজনকে পাওয়া যাবেনা যে উঁচু গলায় ইসরাইল নামক অবৈধ রাষ্ট্রের বর্বরতার সমালোচনা করতে পারবে। মার্কিনীদের সবাই ইসরাইল প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে এমনটা বিশ্বাস করার কোন ভিত্তি নেই। কিন্তু জার্মানদের মত তাদেরও বাক স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে গেছে অর্থনীতির বেড়াজালে। আজকের মার্কিন আধা কালো, আধা মুসলিম প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলি বর্বরতার বৈধতা দিচ্ছেন ভাবার কোন কারণ নেই। প্রেসিডেন্ট ও ব্যক্তি ওবামার দন্ধ এখানেই। একজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টেরই অধিকার নেই ইসরাইলের বিপক্ষে যাওয়ার। কারণ তাদের অর্থেই নির্বাচিত হন দেশটার প্রেসিডেন্ট।

প্যালেস্টাইন সমস্যার আশু ও দ্রুত কোন সমাধান নেই বিশ্ব সমাজের কাছে। এ সমাধান নিহিত আছে অর্থনীতির চাবিকাঠিতে। যতদিন ইহুদিরা বিশ্ব অর্থনীতির চালকের আসনে থাকবে ততদিন নিজঘরে উদ্বাস্তু প্যালেষ্টাইনিরা যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত হতে থাকবে। বুলেটের বদলে বুলেট তত্ত্ব এ সমাধানে কোন ভূমিকা রাখবেনা। ইহুদিদের পতন তাদের থিওরি দিয়েই নিশ্চিত করতে হবে। আর তা হল অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ। ইহুদিরা পারলে আরবদেরও পারতে হবে। এখানে ধর্ম কোন ফ্যাক্টর নয়।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন