শনিবারের চিঠি, বিকেলে ভোরের গল্প

Submitted by WatchDog on Sunday, July 24, 2011

১) সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। রাজনৈতিক শকুনদের ডানায় তখনও পাখা গজায়নি। প্রতিপক্ষের কাউকে জবাই করে টুকরা টুকরা লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেয়ার সংস্কৃতিও তখন বঙ্গভবন হতে NOC পায়নি। তেমনি এক সময়ের কথা। দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে গেছি দুরের দেশ রাশিয়ায় (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন)। আমার সাথে আরও বেশ কজন স্বদেশি। উদ্দেশ্য লেখাপড়া হলেও পাশাপাশি বন্ধুপ্রতীম দেশের সাথে সম্পর্ক চিরস্থায়ী করার একটা অলিখিত মিশনও (সরকারী) ছিল আমাদের তালিকায়। বয়স কম, তাই সরকারের দেয়া দায়িত্ব কতটা পালন করছি তা মাপার উপায় ছিলনা। তবে লেখাপড়ায় আমরা কেউ খারাপ ছিলাম না। বিশেষ যাচাই বাছাইয়ের পরই কেবল সরকার এ কাজে আমাদের পছন্দ করেছিল। ভালমন্দ মিলিয়ে দিন চলে যাচ্ছিল নতুন দেশে, দিন শেষে রাত আসছিল এবং ঋতুর পালাক্রমে বছরও ঘুরে যাচ্ছিল একে একে। থাকি সেন্ট পিটার্সবার্গে (তৎকালীন লেনিনগ্রাদ)। সে বছর গ্রীষ্মের শুরুতে বিশেষ একটা কাজে মস্কোস্থ দূতাবাসে যেতে হয়েছিল। ৪ রুবেল দিয়ে ১ ডলার কেনা-বেচার ব্যবসা সহ হরেক রকম অবৈধ ব্যবসায় ব্যস্ত গোটা হাইকমিশন। আমার ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ মরহুম আলাউদ্দিন আল আজাদ স্যার তখন হাইকমিশনের শিক্ষা এট্যাসে। কাজটা ছিল আসলে উনার কাছেই। সূত্র মারফত জানা গেল ছাত্রদের দেয়ার মত যথেষ্ট সময় নেই স্যারের হাতে। ইদানিং উনি ব্যস্ত মহিলাদের মন জয় করার মিশনে। কাজ হয়নি, তাই মন খারাপ করে উলটো পথ ধরলাম। রাত ১০:৫৫ মিনিটের ট্রেন ধরার জন্যে চলে গেলাম লেলিনগ্রাদস্কি বোকজালে।

বছরের এ সময়টা রাত বলতে তেমন কিছু থাকে না পৃথিবীর এ অংশে। ১১/১২ টার দিকে দিনের আলো কিছুটা ফিকে হয়ে আসে এবং ভোর ৩টার দিকে আবারও ফর্সা হতে শুরু করে। সেন্ট পিটার্সবার্গ অবশ্য এ দিক হতে বেশ কিছুটা এগিয়ে। সূর্যের রাজত্ব থাকে প্রায় ২৪ ঘন্টা, তাও আবার প্রায় ২ মাস। ঝকঝকে ট্রেনটা প্লাটফর্মে ভিড়তে মনটা হাল্কা হয়ে গেল। সারাদিনের ক্লান্তি মুহূর্তেই মুছে গেল ৮ ঘন্টার বিলাসবহুল জার্নির কথা মনে করে। নিজের রুমে ঢুকতে যাব এমন সময় গার্ডের একটা কথায় সজাগ হয়ে গেলাম। ভিভিআইপি কেউ একজন যাচ্ছেন আমাদের ট্রেনে এবং তিনি অবস্থান করছেন আমার ঠিক পরের কক্ষটায়। শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেনীর বিন্যাস নেই, তাই যত বড় ভিআইপি হোক না কেন ট্রেন জার্নি করতে হবে একই শ্রেনীতে, এটাই এ দেশের নিয়ম। কামড়ায় ঢুকে ঘুমের আয়োজন সমাপ্ত করলেও পাশের কামড়ায় কে আছেন জানার জন্যে মনটা আনচান করছিল। ঠিক ১০:৫৫তেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। কৌতুহল মেটাতে বিছানা ছেড়ে ট্রেনের করিডোরে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। যেই হোক না কেন দরজা খুলে তাকে বাইরে আসতেই হবে, অন্তত প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। অপেক্ষার শেষে যাকে দেখলাম তাকে দেখার জন্যে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্মুখ ছিল তখন। আনাতোলি কারপভ। দাবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। সবেমাত্র ফিলিপিনসের বাগুইয়োতে কর্চোনোইয়ের সাথে নিজের টাইটেল ডিফেন্ড করে ফিরেছেন। উত্তেজনাপূর্ণ এ ম্যাচ গোটা জাতিকে পায়ের উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল বেশ কিছুদিন। দাবার ‘দ‘ পর্যন্ত বুঝিনা তখন, কিন্তু আনাতোলি কারপভকে জানতে খুব একটা জ্ঞানের দরকার হয়নি।

কক্ষ হতে বের হয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালেন এবং আর দশটা যাত্রীর মত নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন বাইরের দিকে। কোত্থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। হাল্কা একটা সালাম দিতে মৃদু হেসে ফিরিয়ে দিলেন সালাম। কোন পুরুষের গলা এমন মিহি হয় তা কানে না শুনলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেয়ে মানুষের গলা ভেবে কেউ যদি ভুল করে দোষ দেয়ার কোন কারণ ছিলনা। কারপভের সবকিছুই ছিল মেয়েলি। আকারে ওজনে গড় রুশদের চাইতে বেশ ছোট ও হাল্কা। একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অনেকক্ষণ করিডোরে দাড়িয়ে আকাশ দেখবেন এমনটা ভাবার কোন কারণ ছিলনা। শুভরাত্রি জানিয়ে কক্ষে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তেই করে বসলাম প্রশ্নটা, ’আচ্ছা লোকে বলাবলি করে আপনার মিনিটে হার্টবিট নাকি ৫০, কথাটা কি সত্য? হাসির আভাটা চাইলেও লুকাতে পারলেন না। ’এটা জানতে আপনাকে আমার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতে হবে’। হাসতে হাসতে ফিরে গেলেন নিজের কক্ষে। যাওয়ার আগে ছোট্ট একটা উপদেশ দিতে ভুল করলেন না, ’রেড মীট কম খাবেন, দেখবেন আপনার হার্টবিটও কমে গেছে’।

২) জাতির পিতা আর স্বাধীনতা ঘোষকের ব্যকইয়ার্ডে রোপিত নষ্টামির বীজ ততদিনে চারা হয়ে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে বাংলাদেশের আকাশে বাতাসে। তেমনি এক সময়ের কথা। থাকি নিউ ইয়র্ক শহরের কুইনস এলাকার ছোট্ট একটা বেইসমেন্টে। জীবন একেবারেই সাদামাটা। সকালে কাজে যাই, বিকেলে ঘরে ফিরি। বন্ধু বান্ধব আর পরিচিতদের সার্কেলও সীমিত। কাজটাও খণ্ডকালীন, স্থানীয় একটা মলে কমিশন ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ বিক্রি করি। এখানেই পরিচয় হয় গোপালগঞ্জের একজনের সাথে। আসল নামটা দেয়া বোধহয় উচিৎ হবেনা, লেখার খাতিরে ধরে নেই ভদ্রলোকের নাম শীতল শর্মা। ভালমন্দ মিলিয়ে আর দশটা বাংলাদেশির মতই সাধারণ মানুষ আমাদের শীতল শর্মা। শুধু একটা জায়গায় বেশ পার্থক্য। মুসলমান শব্দটায় উনার ভয়াবহ এলার্জি। মুখের কথা বিশ্বাস করলে আমাদের মানতে হবে উনি একাধারে কবি-সাহিত্যিক, মানবতাবাদী এবং ভাল জিনিসের নিবিড় পুজারী। কিন্তু একটা জায়গায় উনি বেজায় কট্টর, মুসলমান ও ইসলাম ধর্ম। কথায় কথায় খিস্তি খেউড়ি আর মুসলমানদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার যেন উনার দৈনন্দিন কাজ। সময়টা ৯/১১’র ঘটনায় মার্কিন সমাজ ক্ষতবিক্ষত হওয়ার সময়। ইসলাম ও মুসলমান নিয়ে ঘোর সন্দেহ চারদিকে। সমাজে ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখতে মার্কিন প্রচার মাধ্যম যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। সময়ের প্রবাহে মার্কিনিরা শীতল হয়ে আসলেও আমাদের শীতল শর্মাকে কিন্তু এ ব্যাপারে শীতল করা যায়নি। ’গরুখোর শেখদের’ নিয়ে নোংরা কটুক্তি উনার ধমনীতে যেন স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। ৯/১১’র ঘটনাকে মার্কিনীদের চাইতেও বেশি পার্সোনাল হিসাবে নিয়েছিলেন এবং ধর্ম হিসাবে ইসলাম কতটা সন্ত্রাসী তার বিশদ বর্ণনা দিতেন অনেকটা উন্মাদের মত। বিদেশে শত্রু তৈরীতে আমার রেকর্ডে নেই, তাই শর্মা বাবুর কথা গুলো আমল দিতে চাইতাম না। নিজে যদিও ধার্মিক নই কিন্তু তাই বলে মা-বাবা সহ ১.২ বিলিয়ন মানুষের একটা বিশ্বাসকে এভাবে ক্ষতবিক্ষত করবে, তাও আবার দেশপ্রেমের দাবিদার একজন স্বদেশি, ব্যাপারটা হজম করতে বেশ কষ্ট লাগত। কিন্তু সময় ও বাস্তবতার কারণে তা বাধ্য হয়ে গিলতে হত। একদিন ফ্যামিলি সহ বাজার করতে এসেছেন আমাদের স্টোরে। স্ত্রী আর বালবাচ্চা সহ মাথায় তুলে নিয়েছেন গোটা দোকান। জিনিষপত্র উলটপালট আর তচনচ করে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করেছেন চারিদিকে। পাশে বসে একজন পরিচিত কালো আমেরিকান লক্ষ্য করছিল শর্মা পরিবারের এহেন কর্মকান্ড। লোকটাকে আমি চিনি। একটু খ্যাপাটে টাইপের এবং চরম ড্রাগাসক্ত। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত গর্জে উঠল সে। চেচামেচি আর হৈচৈ শুরু করে দিল উঁচুস্বরে। ’ইউ ফাকিং মুসলমান, হোহাই ডোন্ট ইউ গো ব্যক টু ইওর ওউন কান্ট্রি এন্ড লিভ আস এলোন’। বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল চরম মুসলমান বিদ্বেষী এই দাদা। বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছিল সাহায্যের আশায়। মুখ দিয়ে কিছু একটা বের করতে তেড়ে এল শক্তিশালী লোকটা। মনে হচ্ছিল মারতে যাবে সে শর্মা বাবুকে। কেন জানি উপভোগ করতে শুরু করলাম দৃশ্যটা। মনে হল শর্মা বাবুর পাওনা হয়ে আছে এমন কিছু। সিকিউরিটি এসে ধরে নিয়ে গেল ড্রাগাসক্ত লোকটাকে। বাবু অনেকটা কৈফিয়তের সুরে জানতে চাইলেন সাহায্যে নিয়ে কেন এগিয়ে এলাম না। অনেকদিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ একসাথে ঝাড়ার সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহার করতে কার্পণ্য করলাম না। ’তা দাদা আপনার শরীরের বিশেষ অঙ্গটা কাপড় দিয়ে না ঢেকে বরং নেট দিয়ে ঢাকলেই তো লোকে বুঝতে পারবে আপনি মুসলমান নন’। মাথায় লাল রংয়ের গভীর সিঁদুর দেয়া স্ত্রী কেবল ছে ছে বলতে শুরু করলেন এমন সময় সিকিউরিটি এসে শর্মা পরিবারের সবাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে নীচে নিয়ে গেল। অভিযোগ, শপলিফটিং। এরপর আর কোনদিন এই সাহিত্যিক-কাম-মানবতাবাদী-কাম-দেশপ্রেমিকের সাথে দেখা হয়নি। অফিসে খোজ নিয়ে জেনেছি সস্ত্রীক দুইদিন জেলে ছিলেন। অবশ্য বেয়ারা টাইপের দুটো ছেলেমেয়ে এই দুইদিন কার হেফাজতে ছিল তা আর জানা হয়নি।

৩) আমার এক ফিলোসফার টাইপের আমেরিকান বন্ধু মুসলমানদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বুঝিয়েছিল অতিরিক্ত রেডমীট ভক্ষণই নাকি এই ধর্মালম্বীদের উন্মাদনার আসল কারণ। উদাহরণ হিসাবে টেনে এনেছিল কুরবানী ঈদ প্রসঙ্গ। শীতল শর্মাও মুসলমানদের নিয়ে ঠাট্টা করত তাদের গোমাংস ভক্ষণের অভ্যাস নিয়ে। মুসলমানদের সময়টা আসলেই ভাল যাচ্ছে না। তা না হলে ব্যঙের ঠ্যাং মেলার মত সমস্যা জর্জরিত বাংলাদেশের একজন ’সংখ্যালঘু’ একই দেশের একজন ’সংখ্যাগুরু’ নিয়ে এমন নোংরা, তীর্যক আর অশ্লীল কথাবার্তা বলতে সাহস পেতেন না। যাই হোক, শান্তিপ্রিয় নরওয়েতে ঘটে যাওয়া সন্ত্রাসী ঘটনার খবরটা শোনার সাথে সাথে মাথায় বেজে উঠল শীতল শর্মা আর আনাতোলি কারপভের কথাগুলো, রেডমীট! অনেকের মত আমিও ধরে নিয়েছিলাম মুসলমানদের কাজ। অবশ্য শেখ হাসিনাকে নোবেল না দেয়ায় নরওয়েজিয়ান আওয়ামীদের কেউ এ কাজ করে থাকতে পারে এমন একটা সন্দেহ যে উকি ঝুকি দেয়নি তা নয়। খুনের আসামীদের বাঁচানোর পবিত্র দায়িত্বে আছেন কিশোরগঞ্জের জিল্লুর মিয়া। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ হতে নরওয়ের অসলো কি খুব বেশি দূর?

টিমোথি ম্যাকভেইকে যেদিন ফাঁসি দেয়া হয় সেদিন আমি টেক্সাসের ডালাসে। স্থানীয় মিডিয়া এই ফাঁসি পর্ব সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। ওকলাহোমা সিটির ফেডারেল বিল্ডিং উড়িয়ে দিয়ে ১৯ শিশু সহ ১৬৮ জন মার্কিনি হত্যার নায়ক কিন্তু রেডমীট খোর মুসলমান ছিলনা। সে ছিল উগ্র ও রক্ষণশীল খ্রীস্ট ধর্মের গোড়া সমর্থক। নরওয়ের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের সাথেও উগ্র মৌলবাদী মুসলমানদের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। ঘটনার নায়ক আন্ডার্স বেহরিং ব্রেইভেক নিজেকে রক্ষণশীল খ্রীষ্টান ও চরম ইসলাম বিরোধী হিসাবেই পরিচয় দিয়েছেন। ধর্ম ইটসেলফ কখনো সন্ত্রাসী হতে পারেনা হোক তা ইসলাম, হিন্দু, জুডেইজম অথবা খ্রীষ্ট। যদি তাই হত তাহলে ধর্মের কাধে চড়ে মানব সভ্যতা এ পর্যন্ত আসতে সক্ষম হত না। একজন ওসামা মানেই ইসলাম ধর্ম নয়, গুজরাটের নরেন্দ্র মোদিও হিন্দু ধর্মের আইকন নন। টিমথি ম্যাকভেই আর আন্ডার্স ব্রেইভেক ওসামা ও নরেন্দ্র মোদিদেরই একজন। ওদের একটাই পরিচয়, সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসীদের কোন ধর্ম থাকতে পারেনা, ওদের ধর্ম খুন। বন্দুকের নল আর রক্তের হোলি খেলতে গরুর মাংসই যে একমাত্র খাদ্য নয় নরওয়ের ঘটনা তা নতুন করে প্রমান করেছে। আশাকরি পশ্চিমা দুনিয়া এ হতে শিক্ষা নেবে। আর আমাদের শীতল শর্মাদেরও সময় এসেছে নিজেদের অসহায়ত্ব জাহির করার আগে অন্য ধর্মের প্রতি সন্মান শ্রদ্ধা কিছুটা বাড়ানোর।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন