আমেরিকান ড্রিম ও একজন হাফ কালো, হাফ মুসলিম প্রেসিডেন্ট

Submitted by WatchDog on Saturday, May 31, 2014

American Dream

২০০৪ সাল। মার্কিনীরা তৈরি হচ্ছে তাদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য। জর্জ ওয়াকার বুশ তার দ্বিতীয় টার্মের জন্য লড়াই করছেন প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেট জন কেরির বিরুদ্ধে। প্রথা অনুযায়ী দুই দলেরই ন্যাশনাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচনের আগে, যেখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে নিশ্চিত করা হয় দলীয় মনোনয়ন। উপর নীচ লেভেলের অনেক বক্তা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরে দেশবাসীকে ভোট দেয়ার আহ্বান জানান। কনভেনশনের শেষ পর্যায়ে কী নোট নিয়ে হাজির হন এমন একজন যার প্রভাব থাকে সমাজের সর্ব পর্যায়ে। কিন্তু এ যাত্রায় এমন একজন হাজির হলেন দেখে অনেকেই অবাক হল এবং ডেমোক্রেটদের পছন্দের সমালোচনা শুরু করে দিল। আমেরিকায় বাস করছি চার বছর। দুই দলীয় রাজনীতির মারপ্যাঁচ এবং নির্বাচনে কর্পোরেট আমেরিকার প্রভাবের অনেক কিছু তখনও শেখা বাকি। টিভি পর্দায় প্রধান বক্তা হিসাবে একজন নিগ্রোর আবির্ভাবে মোহিত হলাম। কাগজে কলমে দাসপ্রথার অভিশাপ দুর করা গেলেও বাস্তব আমেরিকায় এ অভিশাপের রাজত্ব এখনো অনেক শক্ত। মন্ত্রমু© হয়ে শুনে গেলাম শিকাগোর সিনেটর বারাক হোসেন ওবামার ভাষণ। বাবা বিদেশি। আমেরিকায় পড়তে এসেছিলেন সুদূর কেনিয়া হতে। একজন গৃহ-ভৃত্যের সন্তান তার বাবা জীবনের অনেকটা সময় পার করেছেন গ্রামে ছাগল চড়িয়ে। দাদার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে লেখাপড়া করাতে একদিন আমেরিকায় পাঠাবেন। সে স্বপ্ন একদিন সফল হয়। বাবা ওনায়েনংগো (হোসেন) ওবামা বৃত্তি নিয়ে চলে আসেন আমেরিকায় এবং শুরু করেন নতুন জীবন। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় পরিচয় হয় ষ্ট্যানলি এন ডানহামের সাথে। ১৯৬১ সালে বিয়ে করেন এবং তিন বছর পর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। এর মাঝে জন্ম হয় একমাত্র সন্তানের। বাবার নামে নাম রাখেন ওবামা। এন পরবর্তীতে অন্য একজনকে বিয়ে করে চলে যান দুরের দেশ ইন্দোনেশিয়ায়। বারাক ওবামার লেখাপড়া শুরু সেখানেই। দেশটার চার বছর বাস করার পর ফিরে আসেন হাওয়াই দ্বীপে। নানা নানীর কাছে মানুষ হতে থাকেন পর্যায়ক্রমে। আইনজীবী ও সমাজকর্মী ওবামার রাজনৈতিক উত্থান ছিল বিস্ময়কর। ক্রাইম জোন শিকাগোর গরীব কালো আমেরিকানদের সামাজিক জীবন উন্নত করার মিশন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেন জনসেবায়। ন্যাশনাল কনভেনশনের মুল বক্তা হিসাবে যুবক সিনেটর ওবামাকে হাজির করা ছিল তারই প্রতিদান। সে রাতে মু© হয়ে শুনছিলাম গৃহ-ভৃত্য পরিবারে জন্ম নেয়া একজন আমেরিকান নিগ্রোর কাহিনী। বন্ধু মুরশেদ ছিল আমার পাশে। ভাষণ শেষ হতে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল একটা ভবিষ্যৎ বানী, এ নিগ্রো একদিন না একদিন প্রেসিডেন্ট হবে এ দেশের। কথাটা শুনে মোর্শেদ ফস করে হেসে ফেলল এবং আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো এমন সম্ভাবনা হতে আমেরিকা এখনো দুই শত বছর পিছিয়ে।

দলীয় কর্মী না হয়েও ২০০৮ এবং ২০১২ সালের প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ওবামার হয়ে কাজ করেছি। খোদ ওবামা সহ তার নির্বাচনী টীমের প্রায় সবাই সপ্তাহে একাধিক ই-মেইল পাঠিয়ে উৎসাহ ও সাহস যুগিয়েছিলেন। পাশ করার পর হতে আজ পর্যন্ত হোয়াইট হাউসের যত সিদ্ধান্ত তার ভালমন্দ জানতে চেয়ে এখনো মেইল পাঠান খোদ প্রেসিডেন্ট। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের মত ক্ষমতা অথবা রাজনীতি এ দেশ One Man Show নয়। প্রেসিডেন্ট, সিনেট এবং কংগ্রেসের অনুমোদন থাকলেই কেবল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পরিণত হতে পারে আইনে। যদিও প্রেসিডেন্টের থাকে ভেটো ও নির্বাহী আদেশ দেয়ার ক্ষমতা। কিন্তু তার ব্যবহার খুবই সীমিত। এ যাত্রায় ডেমোক্রেটদের হাতে প্রেসিডেন্সি ও সিনেট থাকলেও কংগ্রেসে মেজরিটি রিপাবলিকানদের। এবং এখানেই নিহিত প্রেসিডেন্ট ওবামার সীমাবদ্ধতা। তা ছাড়া অলিখিত নিয়ন্ত্রক হিসাবে এই তিন সংস্থার মাথার উপর ঝুলতে থাকে কর্পোরেট আমেরিকার খড়গ। বিশ্বজুড়ে মার্কিনীদের বদনামের শেষ নেই। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাক সহ পৃথিবীর অনেক দেশের সাধারণ মানুষের রক্ত তাদের হাতে। ওবামার নির্বাচনী ইস্যুর অন্যতম ইস্যু ছিল যুদ্ধবাজ তকমা হতে আমেরিকাকে মুক্ত করা। এ সিদ্ধান্ত রাতারাতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিলনা দেশটার ক্ষুধার্ত কর্পোরেশন এবং তাদের অন্যতম সহযোগী রিপাবলিকানদের কারণে। হাজার বাধা সত্ত্বেও ওবামার প্রথম টার্মে মার্কিনীরা সড়ে গেছে ইরাক হতে। সামনের বছর পাততাড়ি গুটাচ্ছে আফগানিস্তান হতে। খোদ মার্কিন জনগণও বুঝতে পারছে যুদ্ধের নামে পৃথিবীর দেশে দেশে সৈন্য পাঠিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়ার ভেতর তাদের স্বার্থ নেই, আছে অস্ত্র ব্যবসায়ী বিলিয়নিওরদের স্বার্থ।

বারাক হোসেন ওবামা। একজন কেনিয়ান ইমিগ্রেন্টের হাফ কালো হাফ সাদা, হাফ মুসলিম হাফ খ্রিষ্টান সন্তান পৃথিবীর সব চাইতে শক্তিশালী দেশের প্রেসিডেন্ট। আমেরিকান ড্রিম বলে একটা কথা চালু আছে এখানে। যোগ্যতা এবং চেষ্টায় সবই সম্ভব এ দেশে। ওবামা তার জ্বলন্ত উদাহরণ। ইহুদি নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও বর্ণবাদে ক্ষতবিক্ষত দেশে একজন আধা মুসলিম, আধা কালো নাগরিক প্রেসিডেন্ট, এ কেবল আমেরিকাতেই সম্ভব। পৃথিবীর অন্যকোন দেশে নয়। হাজার অপরাধ বোধের ফাঁকেও আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে বছরের পর বছর ধরে গণতন্ত্র কাজ করে যাচ্ছে। তাই ক্ষমতা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেয়ার কোন সুযোগ নেই এ দেশে। নেই পারিবারিক দাসত্বের স্থান। ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে অর্থনৈতিক দস্যুতাই রাজনীতির একমাত্র উদ্দেশ্য নয় এখানে। তাই বিশেষ বাহিনী পাঠিয়ে প্রতিপক্ষকে গুম খুন করে লাশ নদীতে ডুবিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়না। কেন্দ্র দখল করে ব্যালট ছিনতাই এ দেশে রাষ্ট্রীয় অপরাধ। শতকরা ৫ ভাগ ভোটারের উপস্থিতির ভোট এ দেশে ভোট নয়। গায়ের জোরে, বন্দুকের নলের মুখে স্বঘোষিত অবৈধ ও জারজ সরকারের স্থান নেই এ দেশের রাজনীতিতে। এখানে রাজনীতি মানে পশুত্ব নয়। রাজনীতিবিদ মানে লুটেরা নয়। বিচার ব্যবস্থাও ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট খাওয়ার বেওয়ারিশ কুকুর নয়।

ভালো লাগলে শেয়ার করুন