একজন আবুল হোসেনের আবুলীয় কাহিনী

Submitted by WatchDog on Monday, February 1, 2010

Bangladeshi

দিন তারিখ মনে রাখার অভ্যাস নেই, তাই ঘটনার তারিখটা (এমনকি সন) চাইলেও মনে করতে পারছিনা। অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দল বিশ্বচ্যম্পিয়নের মুকুট নিয়ে সবেমাত্র দেশে ফিরেছে। দেশটার ক্রিকেট পাগল প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড সিদ্বান্ত নিলেন জাতীয় বীরদের এই বীরত্বকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করতে হবে। কোন এক রোববার, সরকারী ছুটির দিন, সিডনীর ডার্লিং হারবারে নিমন্ত্রন জানানো হল শহরের ক্রিকেটপ্রেমী বাসিন্দাদের। ওরা এল, সংখ্যায় হাজার হাজার। হরেক রকম পোশাক, হাতে বাহারী রংয়ের ফেষ্টুন সহ অনেকে এল সপরিবারে। ক্রিকেটারদের আনা হল হুড খোলা গাড়িতে করে। চারদিকে বীয়ারের ফোয়ারা বয়ে গেল, কনফেটির বন্যায় ভেসে গেল ডালিং হারবার, অক্সফোর্ড ষ্ট্রীট সহ শহরের মূল রাস্তাগুলো। অজিরা নাচলো, গাইলো, পাশাপাশি খেলোয়াড়দের বেধে ফেলল ভালবাসার র্নিভেজাল বন্ধনে। পার্টি শেষে যে যার ঘরে ফিরে গেল, সোমবার সকাল হওয়ার আগেই রাস্তাঘাট পরিস্কার করে মুছে ফেলা হল আগের দিনের চিন্‌হ।

স্থান মাদারীপুরের কালকিনি নামের ছোট্ট একটা শহর। সময় গভীর রাত। শহরের কালকিনি নদীর উপর হেক্সাগন ডেভেলাপমেন্ট লিঃ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেঁতু বানানোর চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে কারণ নির্মান কাজ এগুচ্ছেনা কিছুতেই। নদীতে সেন্ড বয়েলিং হচ্ছে প্রচন্ড, তাই পাইলিং করা সম্ভব হচ্ছেনা। এ নিয়ে সেঁতু কর্ত্তৃপক্ষ (এলজিআরডি) প্রতিনিয়ত B-B-Q বানাচ্ছে ঠিকাদারদের। কাজ সমাধা করায় বাকি পূঁজি কোত্থেকে আসবে এ নিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানে চলছে শোকের মাতম। রাত ২টা হবে তখন, একদল অস্ত্রধারী নিঃশব্দে প্রবেশ করল ঠিকাদারদের স্থানীয় ক্যাম্পে। যতটা সম্ভব মালামাল সহ ২জন দক্ষ শ্রমিককে অপহরন করে রাঁতের আধারে মিলিয়ে গেল বিনা বাধায়। ভোরের আলো ফোটার সাথে ক্যাম্পে হাজির হল একদল ’মুরুব্বী’, রাতে যা ঘটে গেছে তার একটা ফয়সালা করার মধ্যস্থতা করতে চান উনারা। ৫ লাখ টাকা হলেই লোক দুটোকে ফেরৎ পাওয়া যাবে, সাথে পাওয়া যাবে বাকি কাজ বিনা বাধায় সমাপ্ত করার নিশ্চয়তা, এবং দ্বিতীয় কোন দস্যুদল যাতে হানা দিতে না পারে তার জন্যে ২৪/৭ পাঁহাড়ার ব্যবস্থা। ৫ লাখ দূরে থাক, ৫ হাজার টাকার জন্যেই ঠিকাদার ধর্না দিচ্ছে দুয়ারে দুয়ারে। অনোন্যপায় হয়ে শহরের মালিক জবান আবুল হোসেন সাহেবের শরনাপন্ন হল তারা। সৈয়দ আবুল হোসেন, কালকিনি রাজনীতির ধ্রুব নক্ষত্র, সদ্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মা-বাবা, সংসদ সদস্য, এবং বলা হয় শহরের গাছপালাও সেজ্‌দা দেয় ’মহান’ এই মানুষটাকে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মহামানবের দেখা পেল সমাজের অন্যতম ’উচ্ছিষ্ট’ ঠিকাদারের দল। শহর-বাবা রাগে ক্ষোভে ফেটে পরলেন বাবার দুয়ারে ধর্ন না দিয়ে এলাকায় এত বড় একটা নির্মান কাজ হাতে নেয়ার জন্যে। বাবা নির্দেশ দিলেন কাজ বন্ধ ও ক্যাম্প গুটিয়ে শহর ছেড়ে দ্রুত পালানোর জন্যে। এর পরের ঘটনা বাংলাদেশের নৈমত্তিক ঘটনার পুনঃপ্রদর্শন মাত্র যা নিয়ে লেখালেখির খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়না। তবু বলছি। ঠিকাদার ঢাকায় ফিরে যোগাযোগ করেন অন্য এক বাবার সাথে, বাবায় বাবায় কথা হয় এবং শেষ পর্য্যন্ত দফা হয় কালকিনি বাবার ৬জন স্বসস্ত্র গুন্ডাকে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী দেয়ার মাধ্যমে। ১ বছরের কাজ আড়াই বছরে শেষ করে ঠিকাদার যেদিন কালকিনি হতে বিদায় নেয় ততদিনে তাদের প্রতিষ্ঠানের জ্বলে গেছে মৃত্যুবাতি।

যোগাযোগ মন্ত্রী আবুল হোসেনের কালকিনি প্রত্যাবর্তন নিয়ে যে রূপকথা পড়লাম, তা নিয়ে দু’কলম না লিখলে বেচারাকে অসন্মান করা হবে নিশ্চয়! নির্বাচনী রায় নিয়ে সেই যে লোকালয় ছেড়ে গেলেন ১৩মাস পর সময় পেলেন গৃহ প্রত্যাবর্তনের। আর সময়ই বা কোথায়? বিডিআর ম্যাসাকার সামাল দিতে হল, বিরোধী দলের বিছানো এয়ারপোর্টের কাঁটা পরিস্কার করতে হল, সংসদে নিয়মিত হাজিরা দিতে হল, তাছাড়া ১৪ হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেঁতুর ব্যবস্থা যে উনাকেই করতে হল। তবু উনি এলেন, নাড়ির টান চাইলেই কি ভুলা যায়? ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মালিকের আগমন কি যেন তেন হলে চলে? তাই এ আগমনকে রাজার আগমন বানানোর সিদ্বান্ত নেয়া হল। উনার SAHCO (শাহ আবুল হোসেন & কোম্পানী - The sky is our limit) সাম্রাজ্যে ১ কোটি এমন আর কি টাকা, তাই নিজ সন্মানের খাতিরেই দিতে হল অংকটা। সে টাকায় হাতী সাজল, ঘোড়া নাচল, স্কুল হতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের রাস্তায় নামানো হল, ঢাকা হতে শিল্পী এল, বিদ্যুতের জন্যে বসানো হল অতিরিক্ত ট্রানসফরমার, আলোর বন্যায় ভেসে গেল কালকিনি নামের ছোট্ট একটা উপজেলা শহর। সাংবাদিকরা অবশ্য সামান্য একটু সমস্যা করল রাজার আগমনের রাজসিক বর্ণনা দিয়ে। আফটার অল জনগণ বলে একশ্রেনীর ’অপদার্থ’ প্রাণী বাস করে বাংলাদেশে, ডাল-ভাতের লড়াই শেষে ঘরে ফিরে এসব রসালো বর্ণনা তাদের হিংস্রতা বাড়িয়ে দেয়। মন্ত্রী জানতেন এমনটা, তাই ধমক দিয়ে সাবধান করে দিলেন বেয়াদব সাংবাদিকদের, একই ধরনের আরও ২০টি সম্বর্ধনা আছে সামনে, এ নিয়ে যেন লেখালেখি না হয়।

আসলেই বোধহয় লজ্জা নেই রাজনীতিবিদ নামের এসব ম্লেচ্ছদের। বছরও ঘুরেনি ১/১১’র দুঃস্বপ্ন হতে, আবারও শুরু হয়ে গেল লুটপাট আর অবৈধ আয়ের উলংগ প্রদর্শনী। বাগান বাড়ির হরিনগুলো হারিয়ে অফিস পিওন ফালু কতটা কষ্ট পেয়েছিল তা উনিই বলতে পারবেন, কিন্তূ আমরা যারা ’অপদার্থ’ প্রাণী, তারা দেখেছিলাম ফালু উত্থান পর্বের অলৌকিক কাহিনী। খুব কি অন্যায় হবে নতুন কোন আউলা ঝাউলা বাউলা সরকার যদি আবুল হোসেনদের মত গডফাদারদের চ্যাংদোল করে নাজিমুদ্দিন রোডের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ঠেলে দেয়? ১৪ হাজার কোটি টাকা প্রকল্পের মালিক আবুল সাহেবের হয়ত মনে নেই রাতের আধাঁরে চেলা-চামুন্ডা পাঠিয়ে ১ কোটি টাকা প্রকল্প মালিকদের পথে বসানোর কাহিনী, কিন্তূ যারা সেদিন পথে বসেছিল, ডাল-ভাতের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে যারা কালকিনি নদীতে দু'ফোটা চোঁখের পানি ফেলেছিল, তাঁরা কোনদিনও ভুলবেনা এ সব হিংস্র হায়েনাদের আসল চেহারা। পয়সার জোড়ে তোরন সাঁজিয়ে, আধিপত্যের দাপটে স্কুল হতে বাচ্চাদের রাস্তায় নামিয়ে আর আলোকসজ্জার প্লাবনে ভেসে আবুল হোসেনরা যতই স্বর্গের কাছাকাছি যাক না কেন, সময়ই এদের আছড়ে ফেলবে কঠিন বাস্তবে। হতে পারে সে বাস্তবতা নাজিমুদ্দিন রোডের লাল দালান!

ভালো লাগলে শেয়ার করুন