বংগবন্ধু বিমান বন্দর পাহাড় বাইয়্যা যায়...

Submitted by WatchDog on Thursday, January 27, 2011

আড়িয়ল বিলে ভিন্ন বাস্তবতা।।

ঢাকার নবাবগঞ্জের খার্হা হয়ে চুড়াইন সড়ক ধরে আড়িয়ল বিলের দিকে যেতে মুন্সিনগর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে চোখে পড়ল একটি অস্থায়ী ঘর। ওপরে শামিয়ানা টানানো, নিচে খড় বিছানো। চারপাশে ‘রক্ত দিব, প্রয়োজন হলে প্রাণ দিব, তবু পৈতৃক ভিটা ও জমি দিব না’ লেখা লাল-কালো রঙের ব্যানার। বিল রক্ষা কমিটির অস্থায়ী ক্যাম্প এটি। মঙ্গলবার বেলা ১১টা, ক্যাম্পে কেউ নেই। রাস্তায়ও লোকজন নেই। গাড়ি চলছে বিলের মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর অংশের দিকে, যেখানে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মূল স্থাপনা হওয়ার কথা। মাঝে এক গ্রামে রাস্তার পাশে ছোট একটি চায়ের দোকান। সামনে একজনমাত্র লোক। তিনি হাত তুলে গাড়ি থামানোর সংকেত দিলেন। পরিকল্পনা ছিল, শ্রীনগরে পৌঁছে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আর আড়িয়ল বিল সরেজমিন দেখতে দেখতে নবাবগঞ্জে ফিরব। তাই আর থামা হলো না। রাস্তার দুই ধারে বিশাল বিল। তার বুকে কোথাও ধান, কোথাও রবিশস্যের সমারোহ, বিশাল বিশাল পুকুর আর মানুষের বাড়িঘর। চোখ জুড়িয়ে যাওয়া এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে মরচিপট্টি পৌঁছে গেলাম দুপুর ১২টায়। ফটোসাংবাদিক সাজিদ হোসেন বললেন, মসজিদের ছাদ থেকে বিলের ছবি নেওয়া যাবে।

মসজিদের সামনে গাড়ি থামাতে না-থামাতেই জনা বিশেক লোক হাজির। ‘আপনারা কারা, কেন এলেন, কে আসতে বলেছে, সরকারি লোক কি না?’ একের পর এক ছুটে আসছে প্রশ্ন। এর মধ্যেই জানা গেল, পেছনে ফেলে আসা চায়ের দোকানের সামনের সেই লোক ফোন করে জানিয়েছে, গাড়িতে করে সরকারি লোক এলাকায় ঢুকছে। আর তাতেই লোকজন বেরিয়ে আসতে শুরু করে। মুহূর্তেই মসজিদের সামনে নারী-পুরুষ মিলিয়ে কয়েক শ লোক, সবাই উত্তেজিত। কারও কারও হাতে লাঠি। যতই বোঝাতে চাই আমরা সাংবাদিক, সরকারি লোক নই, তারা কিছুতেই মানতে নারাজ। মাঝবয়সী একজন এসে বললেন, ‘দেখুন, বিমানবন্দরের কাজের জন্য রোববার সরকারি সার্ভেয়ার এসেছিল, গ্রামবাসী মারধর করে তাড়িয়েছে। এখন সাংবাদিক সেজে সরকারি লোক সার্ভে করতে এল কি না, এটাই সবার সন্দেহের কারণ। আপনারা সাংবাদিক হলে কার্ড দেখান। ততক্ষণে কয়েকজন মারমুখী হয়ে তেড়ে আসতে উদ্যত। ভাগ্য প্রসন্ন, বয়স্ক এক লোক প্রথম আলোর নবাবগঞ্জ প্রতিনিধি আজহারুল হককে চিনতে পারলেন। তিনি এগিয়ে আসেন উদ্ধারকর্তা হিসেবে; নাম হাজি শামছুল হক। একপর্যায়ে আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির আহ্বায়ক শাহজাহান বাদলকে ফোন করেন শামছুল হক। ওই ফোনে এই প্রতিবেদককে কথা বলিয়ে দেন। পরিচয় পেয়ে তিনি জানান, এলাকার লোকজন ক্ষুব্ধ। সরকারি লোক মনে করলে আর রক্ষা নেই। ফোনে তিনি পরামর্শ দিলেন সেখান থেকে সরে আসতে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী আমাদের আসতে দেবে না। এবার নতুন প্রশ্ন, ‘এঁরা মন্ত্রীর পক্ষের সাংবাদিক কি না, তাইলে তো আমাদের বিপক্ষে লিখবে।’ আরেকজন বললেন, ‘মন্ত্রী (নবাবগঞ্জের স্থানীয় সাংসদ এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী) ঢাকায় সাংবাদিকদের কইছে, রক্ত দিয়ে হলেও আড়িয়ল বিলে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করে ছাড়বে। আমরাও কইলাম, রক্ত দিয়া বিল রক্ষা করব। এখন মন্ত্রীর পক্ষের সাংবাদিকদের রক্ত আগে বাইর কর।’

মানুষ বাড়ছে, উত্তেজনাও বাড়ছে। শামছুল হকসহ কয়েকজন আমাদের ঘিরে রক্ষা করার চেষ্টা করছেন। জীর্ণশীর্ণ দেহের একজন তেড়ে এলেন। নাম বললেন, আমানুল। বিলে তাঁর নিজের জমি নেই। পরের জমি বর্গা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর প্রশ্ন, ‘বিল গেলে আমি খাব কী? আপনারা প্রধানমন্ত্রীকে লেখেন, আমাদের পেটে যেন লাথি না মারে।’ পরিস্থিতি ভয়ংকর। নিরুপায় হয়ে প্রথম আলোর প্রতিনিধি ফোন করেন আড়িয়ল বিল রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব সাইদুর রহমানকে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় মুজিবর মাতুব্বর ও বিল রক্ষা কমিটির আরেক নেতা মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিনকে পাঠালেন। মুক্তিযোদ্ধা বোরহান ছোটখাটো বক্তৃতা দিলেন সমবেতদের উদ্দেশে। বললেন, ‘এঁরা সাংবাদিক। মন্ত্রীর লোক নন। আমাদের নেতারা তাঁদের চিনেন। তাঁরা জনগণের পক্ষের লোক। কেউ তাঁদের গায়ে হাত তুলবেন না। তাঁদের গাড়ি ছেড়ে দিন।’
গাড়িতে সামনের আসনে মুক্তিযোদ্ধা বোরহান ও মুজিবর মাতুব্বর উঠলেন। তাঁরা জানালেন, মোবাইল ফোনে খবর ছড়িয়ে গেছে সরকারি লোক এসেছে, তাই পথে পথে গ্রামবাসী গাড়িতে আক্রমণ করে বসতে পারে।
শ্রীনগরের যাত্রা বাতিল করে আবার নবাবগঞ্জের পথে যাত্রা। একটি গ্রাম পার হতেই দূর থেকে দেখা গেল শতাধিক লোক রাস্তায় লাঠি নিয়ে দাঁড়ানো। হাতে ‘রক্ত দেব, তবু মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে দেব না’ লেখা ব্যানার। কাছাকাছি গিয়েই চলন্ত গাড়ি থেকে মুজিবর মাতুব্বর মাথা বের করে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘সরে যান, উনারা সাংবাদিক, আমাদের পক্ষে।’ ওই দিকে তখন মিছিল-স্লোগান। বাড়ি থেকে নারীরাও লাঠি হাতে বেরিয়ে আসছে।

গাড়ি থামার পর জনতার মধ্য থেকে এক যুবক এগিয়ে এসে বলল, ‘আমি প্রথম আলো পড়ি। আপনাদের অসুবিধা নাই। তবে আপনাদের ভাগ্য ভালো, মসজিদের মাইকে ঘোষণা হয়নি, হলে আপনাদের রক্ষা করা কঠিন হতো।’ তিনি জানান, ‘এখানে রাত জেগে মানুষ পালাক্রমে পাহারা দেয়, যেন সরকারি সার্ভেয়ার ঢুকতে না পারে। বলা আছে, সরকারি কেউ ঢুকলে প্রতি গ্রামের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেবে এবং লাঠিসোঁটা নিয়ে বেরিয়ে আসবে।’

একে একে আরও দুটি লাঠিমিছিল পার হয়ে মুন্সিনগরে ঢুকব, গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন এক বৃদ্ধা; হাতে লাঠি। লাঠি বললে বেশি বলা হবে, মোটা ছড়ি। বৃদ্ধার বক্তব্য, ‘আমার জমি নিতে আইছে, লাঠির এক বাড়ি হলেও আমি দিব।’ আমরা আতঙ্কিত। ছোট্ট এই ছড়ির আঘাত খেতে তো অসুবিধা নেই। কিন্তু এটা শুরু ধরে নিলে শেষটা কী হবে, তা যে কেউ অনুমান করতে পারেন। বোরহান ও মুজিবর মাতুব্বরকে তা বলতে হয়নি। তাঁরা নেমে ওই বৃদ্ধাকে বুঝিয়ে বহু কষ্টে রাস্তা থেকে সরাতে সক্ষম হলেন।

মুন্সিনগর উচ্চবিদ্যালয়ের সামনের সেই ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি, মাঠে এক জনসভার লোক। সবাই বিক্ষুব্ধ, উত্তেজিত। আবার পুরোনো প্রশ্নের মুখোমুখি, সরকারি লোক কি না, কার পক্ষের সাংবাদিক ইত্যাদি। বোরহান সাহেব বললেন, ‘সরকার বলছে, কিছু বহিরাগত আর জামায়াত-বিএনপি নাকি বিমানবন্দরের বিরোধিতা করছে। কারা জামায়াত-বিএনপি? এখানে রক্ষা কমিটির তো প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ করে।’ কৃষক কুদ্দুস মিয়া ভিড় ঠেলে এসে বললেন, ‘এখানে আবার দল কী? আপনার ভাতের থালা কাইড়া নিলে আপনি কি বইসা থাকবেন?’
অসংখ্য কুদ্দুস মিয়ার আহাজারি, চিৎকার, চেঁচামেচি চলল অনেকক্ষণ। একজন এগিয়ে এসে বললেন, বিলে আমার ১৩টি ডেঙ্গা (বড় পুকুর) আছে, মাছ চাষ করে সংসার চালাই।’ এ পর্যায়ে সবাইকে শান্ত করলেন স্থানীয় মুরব্বিরা। একজন বললেন, ‘আমাদের এ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হাজি মর্তুজা আলী শিক্ষিত মানুষ, তিনি গুছিয়ে সব বলবেন।’
মর্তুজা আলী এই প্রতিবেদককে উদ্দেশ করে বলতে লাগলেন, ‘এ বিলকে ঘিরে তিন থানার ১০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা চলে। এখানে ইরি ধান হয়। একরপ্রতি প্রায় ১০০ মণ ধান হয়, যা অন্য এলাকার তিন ফসলে হয় না। অসংখ্য ডেঙ্গায় সমৃদ্ধ এই বিলে বছরে আট মাস পানি থাকে। তাতে প্রকৃতিগতভাবে মাছ হয়, চাষের প্রয়োজন হয় না। আড়িয়ল বিলের কই মাছ বিখ্যাত। মাছ ব্যবসায় নির্ভরশীল কয়েক হাজার মানুষ। বর্ষায় শাপলা বিক্রি করে গরিব মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। বিভিন্ন জেলার শত শত কৃষিশ্রমিক এ বিলে কাজ করে। বর্ষায় লাখ লাখ টাকার শামুক সংগ্রহ করে তা চিংড়িঘেরে বিক্রি করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে ডেঙ্গায় মাছ চাষ হয়। পেঁয়াজ-রসুন, সরিষাসহ নানা রবিশস্য চাষ হয়। ঢাকার নয়াবাজারের যে বড় বড় লাউ ও মিষ্টিকুমড়া বিক্রি হয়, সেগুলো এই বিলের।’

একপর্যায়ে এ প্রতিবেদককে বিলের ফসল দেখাতে নিয়ে যান লোকজন। তাঁরা বলেন, ‘সরকার বলছে, বেশির ভাগ জমি পরিত্যক্ত। দেখান তো, কোন জমিটা অনাবাদি!’ এর মধ্যে একজন কৃষক নিজের খেত থেকে দুটি বড় কুমড়া (একেকটির ওজন ১০-১২ কেজি) তুলে এনে এ প্রতিবেদককে বহন করা গাড়িতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। তাঁকে নিবৃত্ত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে বললাম, ‘এত বড় কুমড়া নিয়ে কী করব? আমার বাসায় রান্না করার লোক নেই। এটা আপনি রেখে দেন।’ তাঁর একটাই দাবি—বিলে কী রকম ফসল হয়, তার প্রমাণ হিসেবে এই কুমড়া দুটি নিতে হবে। তাঁর সঙ্গে সুর মেলালেন বাকিরাও। অগত্যা রাজি হতে হলো। কৃষক পিতা বললেন, ‘বাবা, আমাদের আর কিছু নাই।’
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2011-01-27/news/126742

ভালো লাগলে শেয়ার করুন